তারিক আজিজ

  ২৪ জুলাই, ২০১৭

উবারের ভাড়া নিয়ে নতুন ভোগান্তি

রাজধানী ঢাকায় আধুনিক পরিবহন (ট্যাক্সি) প্রতিষ্ঠান উবারের কার্যক্রম বেড়ে চলছে। ইতোমধ্যে উবারের কার্যক্রম যাত্রীদের মধ্যে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট কারে যাত্রীরা উবারের পরিবহন সেবা পাচ্ছে। এছাড়া স্মার্টফোনভিত্তিক যাত্রী সেবাদাতা এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক গাড়ির মালিক ও চালক অর্থ উপার্জন করছেন।

সম্প্রতি উবারের বিরুদ্ধে যাত্রীভাড়া নিয়ে অসঙ্গতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। উবারের কয়েক যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন। এর আগে ঢাকায় উবারের চালক দ্বারা নারীযাত্রী হয়রানির শিকার হয়েছেন। ওই সংবাদ প্র্রকাশের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে উবারের সেবা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সেবা গ্রহণ করে কিছু যাত্রী অপরাধমূলক কাজে জড়িয়েছেন বলেও জানা গেছে। ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, একই রুটে ভিন্ন ভিন্ন হারে ভাড়া আদায় করছে উবার। কিলোমিটার প্রতি ভাড়া এবং গাড়ি ব্যবহারের সময় ও বেইজড চার্জ হিসেবে ৫০ টাকা হিসাব করে উবারের দেয়া ভাড়ার সঙ্গে যাত্রীদের হিসাব করা ভাড়ার সঙ্গে গরমিল পাওয়া যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী যাত্রী জানান, আমি রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার জন্য উবারের গাড়িকে ডাকি। যাত্রাপথ সর্বসাকুল্যে তিন-চার কিলোমিটার ছিল। অথচ গন্তব্যে যেয়ে উবারের ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেশি দেখাচ্ছে। যেখানে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা ভাড়া হওয়ার কথা, সেখানে উবারের অ্যাপস ভাড়া দেখাচ্ছে প্রায় ৬০০ টাকার কাছাকাছি। উবারের চালকের কাছেও বিষয়টি বোধগম্য হয়নি। পরে চালক ২০০ টাকা নিয়ে খুশি মনে যাত্রীকে বিদায় করেছেন। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে উবারের কাস্টমার কেয়ারকে ফোন করা হলে তারা জানান, উবার অ্যাপস যে ভাড়া নির্ধারণ করছে,তাই পরিশোধ করতে হবে। কাস্টমার সার্ভিসকে যাত্রী জানান, এটা কিভাবে সম্ভব? আমি কেন শুধু বাড়তি ভাড়া দেবো। তখন কাস্টমার সার্ভিস থেকে বলা হয়, পরিশোধ করা না হলে আপনার কাস্টমার একাউন্ট বাতিল করে দেয়া হবে। একজন উবার ব্যবহারকারী গ্রাহকের সঙ্গে কাস্টমার কেয়ার সেবাদাতার কাছ থেকে এইরুপ আচরণ কতোটা যুক্তিসঙ্গত, গ্রাহক হিসেবে তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

অপরদিকে আরেক ভুক্তভোগী যাত্রী জানান, সময় সাশ্রয় এবং স্বস্তিতে চলাফেরা করার জন্য আমি প্রায়ই উবার ব্যবহার করে থাকি। তবে ইদানিং উবার বাড়তি ভাড়া আদায় করছে বলে আমার ধারণা। যানজট, অতিরিক্ত সময় ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও যে ভাড়া আসার কথা, এর বিপরীতে কখনো প্রায় একগুণ বেশি ভাড়া আসছে। ৬০০ টাকার ভাড়া আসছে প্রায় ১০০০ টাকার মতো। অন্যদিকে কখনো দেখা গেছে, মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত ভাড়া প্রায় ৮৫০ টাকার কাছাকাছি। যানজটের কারণে সময় বেশি ব্যয় হয়। সে হিসেবে তো আর ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা ভাড়া আসার কথা নয়।

অপর এক যাত্রী জানান, আনুমানিক ভাড়া হিসাব করে উবার ব্যবহার করেছিলেন। গন্তব্যস্থানে পৌঁছে আনুমানিক হিসাব করা ভাড়ার চেয়ে প্রায় ৩০০ টাকা বেশি ভাড়া নির্ধারণ করে উবার। যা আমার জন্য খুবই কষ্টদায়ক। এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও উবারের বাড়তি ভাড়াসংক্রান্ত কয়েকটি পোস্ট দেখা গেছে। তারা অভিযোগ করছেন, ঢাকার রাস্তায় উবার ব্যবহারের পরিধি বেড়ে যাওয়ার ফলে কি বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য কারসাজি করে হয়তো তারা বেশি ভাড়া আদায় করছে।

বাড়তি ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে উবার কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে তারা এ বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিগতভাবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ভাড়া নির্ধারণ করা হয় বলে জানান। যাত্রীদের কাছ থেকে তারা কোনোভাবেই বেশি ভাড়া আদায় করেন না। বরং উবার কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বিঘœ যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তারা ঢাকায় কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি হয়তো কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে উবার কর্তৃপক্ষ দায়ভার নিতে রাজি নয়। আর আর্থিক অসঙ্গতির বিষয়টি তারা খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।

অন্যদিকে গত পাঁচ মাস ধরে প্রতি মাসে ১০ শতাংশের বেশি হারে চালক ও যাত্রী বেড়েছে উবারের। এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে এই বৃদ্ধির হার ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বেশির ভাগ উবার ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা জানিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে এই সেবা যেন ঢাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ট্যাক্সির মতো না হয়ে যায়, সে জন্য যাত্রীসেবা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়া তদারকি জরুরি।

উবারের সেবা নিয়ে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, উবার ট্যাক্সি-সেবাদাতা না শুধু অ্যাপ হিসেবে নিবন্ধিত হবে, তা নিয়ে শুরু থেকেই জটিলতা দেখা দিয়েছে। উবার নিজেকে ‘স্মার্টফোন অ্যাপ’ হিসেবে দাবি করে। এটি ব্যবহার করে ঢাকায় যে গাড়িগুলো ভাড়ায় চলছে, সেগুলোর সবই ব্যক্তিগত হিসেবে নিবন্ধিত। ভাড়ায় গাড়ি চালাতে হলে সরকারকে রাজস্ব দিয়ে রুট পারমিট নিতে হয়। তাই গত বছরের ২২ নভেম্বর ঢাকায় উবার চালুর ঘোষণা দেয়ার তিন দিন পর সড়ক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উবারকে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে সম্প্রতি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) উবারের কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই উবার নিষিদ্ধ হয়েছিল যাত্রীদের নিরাপত্তা না দেয়ার কারণে। কানাডার টরন্টোতে এ কোম্পানি ট্যাক্সি ইউনিয়নের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে। অনেক ইউরোপীয় দেশে কোম্পানি টিকে থাকার জন্য আইনগতভাবে লড়ছে। আবার অনেক দেশে আইনি জটিলতা কাটিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে তারা। ইতোমধ্যে জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশে আইনের ফাঁক গলিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে উবার।

উবার অ্যাপ ব্যবহার করে যাত্রীরা চালকদের তাৎক্ষণিক অবস্থান জেনে নিয়ে তাকে ডাকতে পারেন। ভাড়া হিসাব করা হয় যাত্রী ওঠার পর থেকে। দূরত্ব, ট্যাক্সি ব্যবহারের সময় আর বেইজ প্রাইস মিলিয়ে অ্যাপ ভাড়া হিসাব করে দেয়। যাত্রা শেষে নগদ টাকা বা ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে ভাড়া মেটানো যায়। ঢাকায় প্রতি ট্রিপের ২৫ শতাংশ অর্থ পায় উবার। বাকি ভাড়ার অংশ গাড়ির মালিক ও চালক পায়।

উবারের সেবায় প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীদের গুণতে হয় ২১ টাকা। এর সঙ্গে গাড়িতে কাটানো প্রতি মিনিটের জন্যে ভাড়া গুণতে হয় তিন টাকা করে। বেইজ প্রাইস হিসেবে তার সঙ্গে যোগ হয় ৫০ টাকা। আর ট্যাক্সি ডাকার পর যাত্রা বাতিল করলেও ৫০ টাকা দিতে হয়। উবার কর্তৃপক্ষ বলছে, চালক ও গ্রাহক-দুই পক্ষের সুবিধার কথা বিবেচনা করে সেবার মান ঠিক রাখতেই তাদের এ সিদ্ধান্ত। যদিও ঢাকায় উবার তাদের কার্যক্রম চালুর দুই মাস পর ভাড়া বাড়িয়ে বর্তমান ভাড়া নির্ধারণ করেছিল। যানজট আর নগর পরিবহনের স্বল্পতার এই নগরীতে উবারের সেবা শুরু থেকেই বেশ আলোড়ন তুলেছে।

এদিকে সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীতে উবারসহ অন্যান্য মোবাইল অ্যাপনির্ভর যাত্রী পরিবহন সেবা একটি আইনি কাঠামোয় নিয়ে আসার কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রী বলেন, ঢাকা মহানগরীতে উবারসহ অন্যান্য মোবাইল অ্যাপ নির্ভরযাত্রী পরিবহন সেবা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। নীতিমালা চূড়ান্ত করতে জনগণের পাশাপাশি শিগগিরই অংশীজনদেরও মতামত নেয়া হবে। প্রযুক্তি নির্ভর সেবা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। তবে এ সকল সেবা দেশের প্রচলিত আইন ও কাঠামোর আওতায় আনতে হবে।

ধারণা করা হচ্ছে, উবার বিলিংয়ে বেইজড ফেয়ার, ডিসট্যান্ট, টাইমের পাশাপাশি সারচার্জ বা পিক ফ্যাক্টরের কারণে বিল বেশি আসছে, যা অন্য কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। এবং এর রেট কত বা কোন সময় বা এলাকা পিক আওয়ারের আওতায়, এই ব্যাপারে উবার সঠিক কোনো তথ্য গ্রাহকেদের জন্য দেয়নি। এটি ব্যবসার স্বচ্ছতার প্রতিফলন নয় এবং অনৈতিকও বটে। তাই উবার ব্যবহারকারী যাত্রীদের সুবিধার্তে যাত্রাপথের ভাড়া এবং সার্বিক সেবামূল্য কিভাবে তারা নির্ধারণ করছে, তা সকল যাত্রীর জানা থাকা জরুরি। নয়তো যাত্রীরা কিভাবে বুঝতে পারবেন, উবার যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করছে কি না? একইসঙ্গে উবারের চালক-যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলছে অনেককে।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নতুন ভোগান্তি,উবার,উবারের ভাড়া
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist