কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ২০ জুলাই, ২০১৭

ইমেজ সংকটে চট্টগ্রাম বন্দর

বিদেশি জাহাজ মালিকরা চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানি কনটেইনারের ওপর সারচার্জ আরোপ করেছেন। প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে ১৫০ ডলার এবং প্রতি ৪০ ফুট কনটেইনারে ৩০০ ডলার করে এ চার্জ বসানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের অদক্ষতা ও জাহাজের গড় অবস্থানকাল অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদেশি শিপিং লাইনগুলো গত জুন থেকে এটি কার্যকরের ঘোষণা দেয়। ইতোমধ্যে বিদেশি শিপিং প্রচারমাধ্যমে এটি ফলাও করে প্রচারও করছেন তারা। এর ফলে এখন থেকে আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা চলে যাবে বিদেশি জাহাজ মালিকদের কাছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জনজীবনে। বিশেষ করে রফতানিমুখী গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। বিদেশে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রী গত মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন। বৈঠকে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ব্যবসায়ীদের শিগগির এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। গতকাল বুধবার বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে বৈঠকের কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশে ব্যবসারত বিদেশি জাহাজ মালিক প্রতিনিধি করটিটনেন্টাল গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক আতাউল করিম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বিদেশি জাহাজ মালিকরা এ সারচার্জ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর যে গতিতে চলার কথা সে গতিতে চলছে না। বিশ্বে প্রতিটি বন্দরের গতি বাড়ছে, সেখানে পিছিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। আগামী বছরগুলোয় কনটেইনার বাণিজ্য আরো বাড়বে। এ অবস্থায় বন্দর তাল মিলিয়ে চলতে পারবে কি না সংশয় রয়েছে। শিগগির বন্দর পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

চট্টগ্রাম বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মইনুদ্দিন আহমেদ মিন্টু প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বন্দর পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বিগ্ন। সারচার্জ আরোপের ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি লোকসানও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দর পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দিতে আমরা সরকারের কাছে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে পোশাক রফতানি বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বে।’

বন্দর সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বের ১০০টি বন্দরের র‌্যাংকিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৭৬ নম্বরে। চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে এ হার আরো পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান বৈদিশিক মুদ্রা আয় হয় পোশাক রফতানিতে। আর এসব পোশাক চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সারা বিশ্বে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের অদক্ষতা ও সক্ষমতার অভাবে এ খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত। তারা জানান, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একটি জাহাজ পণ্য খালাস করে পুনরায় বোঝাই করে নিয়ে বন্দর ত্যাগ করতে সময় লাগছে ৭-১০ দিন। অথচ এতে ৪৮ ঘণ্টা লাগার কথা। অনেক ক্ষেত্রে জাহাজের গড় অবস্থানকাল ১৫ দিনে গিয়েও ঠেকছে। আগে বহির্নোঙরে কনটেইনার জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকার তেমন নজির না থাকলেও বর্তমানে গড়ে ১৫টি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাস ও বোঝাই এর শিডিউলের আশায়। বন্দরের প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ব্যবসায়ীদের মাশুল দিতে হচ্ছে।

বন্দরের এমন ধীরগতির কারণ কী-জানতে চাইলে বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন অচল হয়ে পড়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র তিনটি রাবার টায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি জাহাজ মালিকরা সংঘবদ্ধভাবে আরোপ করেছে সারচার্জ। কনজেশন সারচার্জ আদায়ও করতে শুরু করেছে। প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে ১৫০ ডলার এবং প্রতি ৪০ ফুট কনটেইনারে ৩০০ ডলার সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি মাসে এক লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। এসব কনটেইনারের পেছনে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ৩৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় হবে। এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইলের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের অদক্ষতা ও নানা আনুষঙ্গিক কারণে এমনিতেই বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত রফতানিতে ১১ শতাংশ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত ও ভিয়েতনাম ৪০ শতাংশ এগিয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের জন্য কোনো অবস্থাতে শুভসংকেত নয়। দেশের রফতানি খাত পাশের দেশে চলে যাচ্ছে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার-বাণিজ্য শুরুর পর থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং ও শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের সঙ্গে কনটেইনার যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। এখান থেকে পণ্য এ তিনটি বন্দরে যায়। এরপর মাদার ভেসেলের (বৃহদাকার কনটেইনার জাহাজ) মাধ্যমে সারাবিশ্বে এগুলো ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট পণ্য ও এর কাঁচামালও এ তিন বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিদেশি জাহাজ মালিকরাই এ তিন বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির পরিবহন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ তিন বন্দরে যেতে সময় লাগে পাঁচ দিন। ব্যবসায়ীরা এ দিন হিসাব করেই মাদার ভেসেলে পণ্যবোঝাইয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিদেশি আমদানিকারককে জানিয়ে দেন। কিন্তু বন্দরে যখন জট লেগে যায় তখন সময়মতো পণ্য মাদার ভেসেলে ধরানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখন ব্যবসায়ীরা বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে বিমানে অথবা দেরিতে পণ্য সরবরাহ করেন। এর ফলে একদিকে যেমন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তেমনি বিদেশি আমদানিকারকদের কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বপ্রথম কনটেইনার কার্গো আসা শুরু হয়। তখন এখানে শুধু বাল্ক ও ব্রেক-বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিং হতো। কনটেইনার প্রযুক্তি সংযুক্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তৎকালীন সরকার সর্বপ্রথম এ বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণের গুরুত্ব অনুধাবন করে। ১৩নং জেটির ভাটিতে বেক-আপ সুবিধাসহ ২টি মাল্টি পারপাস বাথ নির্মাণ ও কনটেনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে শেষ হয় ‘চিটাগাং কনটেনার টার্মিনাল’র (সিসিটি) কাজ। পরে নির্মিত হয় এক কিলোমিটার দীর্ঘ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। এ টার্মিনালেও কনটেইনার হ্যান্ডলিং কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। তবে এ টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সময় লেগেছে ১০ বছরেরও বেশি সময়।

‘একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নতুন যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি নিয়ে বছরের পর বছর চলেছে প্রতীক্ষা’- জানান বন্দর সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ১২০০ কোটি টাকার নতুন যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টিও হচ্ছে ঢিমেতালে। বর্তমানে বন্দরের যে দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন নষ্ট হয়ে গেছে এগুলো আনতে হবে জাপান থেকে। কবে আসবে এবং দীর্ঘসূত্রতা কতদূর গড়ায় এ নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। ব্যবসায়ীদের কনটেইনার পণ্য রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই বন্দরে। ফলে বন্দর এখন খালি কনটেইনার ফোর্স শিপমেন্ট করার পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন-প্রশ্ন রেখে ব্যবসায়ীরা বলেন, নানা দুর্বলতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না চট্টগ্রাম বন্দর। একশ্রেণির মাফিয়ার হাতে এটি জিম্মি হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বেসরকারিভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আসতে শুরু করে। তার পরও অন্য সমস্যাগুলো থেকেই যায়। বন্দরের ফান্ডে টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকলেও বন্দর উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পগুলো গতি পাচ্ছে না।

বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোর মতো চট্টগ্রাম বন্দরকে ২১ শতকের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ কিছুই হচ্ছে না। কথা ছিল, ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশের চারপাশে থাকা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক হবে। কিন্তু সে সম্ভাবনা ঘটছে না সমুদ্র বন্দরজনিত কারণে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এসব রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য কলকাতা বন্দরকেন্দ্রিক। এ অঞ্চলে কোনো সমুদ্রবন্দর না থাকায় দূর পথ দিয়ে বিপুল খরচে এ অঞ্চলের ব্যবসয়ীরা পণ্য আমদানি-রফতানি করে থাকে। অথচ কাছেই রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাজারগুলো কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে ফিডার জাহাজে করে তাদের পণ্য বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে। এতে সময় ও দাম দুটোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে এসব রাজ্যের ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি-রফতানি করলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চেহারা যেমন পাল্টে যেত; তেমনি সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হতো। তারা পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রাম বন্দরকে অকেজো করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না এবং কী কারণে পিছিয়ে পড়ছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মতো দেন।

পিডিএসও/রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইমেজ সংকট,চট্টগ্রাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist