প্রতীক ইজাজ

  ২৩ জুন, ২০১৭

ঈদ অর্থনীতি কিছুটা মন্দা

ঈদুল ফিতর কেন্দ্র করে বেড়ে গেছে দেশের অর্থনীতির আকার। রমজানের এই ঈদ উৎসব ঘিরে যেমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে, তেমনি চলমান অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বোনাস, প্রবাসী আয় ও গ্রামীণ অর্থনীতির প্রবাহ। এই অবস্থার প্রভাব পড়েছে গোটা অর্থনীতিতে, অর্থাৎ দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায়। তবে গেল বছরের তুলনায় এবার অন্তত ২০-২৫ শতাংশ আর্থিক লেনদেন কম হবে মত দিয়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন ‘কিছুটা মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে’।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, দেশে অন্য যেকোনো উৎসবের চেয়ে ঈদে অর্থের প্রবাহ বাড়ে। যেসব খাত থেকে অর্থের জোগান হয়, সেগুলো হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস, প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স, মানুষের জমানো আয়, রাজনৈতিক নেতাদের দান, অনুদান বা ঈদ বখশিশ, মানুষের জাকাত-ফিতরা, রোজা ও ঈদ কেন্দ্র করে চাঙা হওয়া শহর ও গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎপাদিত পণ্যের বিক্রীত অর্থ, মৌসুমি ফল বিক্রির অর্থ, ব্যাংকগুলোর ছাড় করা কৃষিঋণ ও সরকারি দান-অনুদানের অর্থ। ঈদ অর্থনীতির বেশির ভাগই ব্যয় হয় গ্রামে। এই সময়টাতে শহরের তুলনায় গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ে। ফলে চাঙা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি।

তবে এবার ঈদ অর্থনীতিতে কিছুটা মন্দাভাব দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের মতে, গতবারের তুলনায় এবার ঈদে অন্তত ২০-২৫ শতাংশ আর্থিক লেনদেন কম হবে। কারণ হিসেবে তারা প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাটসহ বিভিন্ন কর আরোপ, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ও দেশের বাইরে কেনাকাটাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ আর্থিক অনিশ্চয়তাকে চিহ্নিত করেছেন। এসব কারণে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মানুষ এই মুহূর্তে ব্যয়ের চেয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু জমানোর কথা ভাবছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঈদে সাধারণত মার্কেটগুলোতে যে ভিড় থাকে, এবার কিছুটা কম। কেনাকাটাও কম। তার মানে, ঈদ অর্থনীতিতে কিছুটা মন্দাভাব। কারণ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। মানুষ এখন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পরিবারের জন্য কিছু সঞ্চয় করে রাখছে। তা ছাড়া অনলাইলেও কেনাকাটা হচ্ছে। অবশ্য এবার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতে গেছে কেনাকাটা করতে। ফলে দেশীয় শিল্পে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদ অর্থনীতির একটি হিসেবে কষেছে ‘দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ (এফবিসিসিআই)। সে সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বার্ষিক অর্থনীতির আকার ১৯ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে এবছর ঈদ অর্থনীতির আকার হবে দেড় লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই অঙ্ক গতবারের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে এফবিসিসিআইর সাবেক সহসভাপতি ও পরিচালক এবং দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন বলেন, গতবারের তুলনায় এবার আর্থিক লেনদেন ২০-২৫ শতাংশ কম হতে পারে। ঈদ অর্থনীতিতে এবার কিছুটা

মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। নতুন বাজেটের ভ্যাট ও শুল্কের কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি প্রচুর মানুষ ভারতে যাচ্ছে কেনাকাটা করতে। ভারত সরকার সে জন্য ভিসা পদ্ধতিও সহজ করেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের ঈদ অর্থনীতিতে। অথচ প্রতিবছর ঈদে গড়ে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ অর্থ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। এবার সেটি হচ্ছে না।

হেলাল উদ্দীন জানান, এই ঈদে কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ ভারতে গেছে ঈদ কেনাকাটা করতে। মাথাপিছু এক হাজার ডলার করে কেনাকাটা করছে। সে হিসাবে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হবে। এই টাকাটা দেশের ভেতর থাকলে অর্থনীতির আকার বাড়ত।

অবশ্য ঈদ অর্থনীতির দেওয়া তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, দেশের ঈদ অর্থনীতি-সংক্রান্ত কোনো গবেষণা নেই। এ সময় অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও এর সুফল সার্বিক অর্থনীতিতে ততটা যোগ হয় না। কারণ, এ সময় একটা অতি মুনাফার প্রবণতা থাকে। মুনাফা বাটোয়ারা হয় অল্প কিছু মানুষের মধ্যে। আর এর প্রবণতা দেখা যায় শুধু শহরকেন্দ্রিক। তবে উৎসবের মৌসুমে অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, যেটা উৎসবের অর্থনীতির সুফল বলে মত দেন তিনি।

এফবিসিসিআই এর সমীক্ষাটি আরো বলেছে, শুধু নতুন পোশাক কেনাকাটায় যাচ্ছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ভোগ্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যুক্ত হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। ধনীদের দেওয়া জাকাত ও ফিতরার মাধ্যমে যোগ হচ্ছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। ইফতার ও সেহরি বাবদ যোগ হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ঈদকেন্দ্রিক বিনোদনে যুক্ত হচ্ছে আরো পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া, পরিবহন খাতে ঈদের ঘরে ফেরা আর কাজে ফেরাতে যুক্ত হচ্ছে অতিরিক্ত ৭০০ কোটি টাকা।

অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশের ২৫ লাখ দোকান রয়েছে (মুদির দোকান থেকে কাপড়ের দোকান)। এসব দোকানে বছর জুড়ে দৈনিক তিন হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হলেও রোজা ও ঈদে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিনগুণ বেশি, অর্থাৎ নয় হাজার কোটি টাকার ওপরে। সে হিসাবে এসব দোকানে লেনদেন হবে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল পোশাকের দোকানেই ঈদের কেনাকাটা এবার ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে বলে জানান দোকান মালিক সমিতির নেতারা।

ঈদের অর্থনীতিতে এক কোটি প্রবাসীর পাঠানো প্রায় ১৫০ কোটি ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকা যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, মে মাসে ১২৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর চলতি জুন মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ৭২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।

সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতেও বেড়েছে লেনদেন। এটিএম বুথে প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করছে গ্রাহকরা। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার বেশি। মানুষের চাহিদা পূরণে বাজারে অতিরিক্ত ২৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের ১২ হাজার কোটি টাকার ঈদ বোনাস। এর প্রায় পুরোটাই গেছে ঈদবাজারে। জাকাতকে ঘিরে গরিব-অসহায় মানুষের মাঝেও ঈদ অর্থনীতির ছোঁয়া লেগেছে।

এফবিসিসিআইএর হিসাবে, দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন কোটি ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে ধনীর সংখ্যা মাত্র ৩০ লাখ। ঈদবাজারে মোট লেনদেনের ৬০ শতাংশই ব্যয় হয় এই উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের কেনাকাটায়। এর বাইরে ঈদ কেনাকাটায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় আরো তিন কোটি ২০ লাখ মানুষ। গত এক দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় দেড় কোটি। তার পরও দেশে সাড়ে ১২ কোটি দারিদ্র্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে নয় কোটি ৮৯ লাখই হচ্ছে দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণে এরা দুর্মূল্যের ঈদের বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। কিন্তু তার পরও সাধ্যমতো সবাই ঈদ কেনাকাটা করে থাকেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদ অর্থনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist