প্রতীক ইজাজ

  ২১ জুন, ২০১৭

স্বস্তির রেলেও দুর্ভোগের শঙ্কা

কিছুটা স্বস্তি পেতে এবারো ঈদযাত্রায় রেলে চাপবে মানুষ। সড়কপথের দুর্ভোগ এড়াতে সময় কিছুটা বেশি লাগলেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল রেলপথই হয়ে ওঠে ওইসব অঞ্চলের মানুষের অন্যতম যানবাহন। সেই যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতিও নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। নিয়মিত ট্রেন ছাড়াও থাকছে ১৪টি বিশেষ ট্রেন। অতিরিক্ত কোচ সংযোজনের মাধ্যমে গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিদিন অতিরিক্ত ৫০ হাজার যাত্রী আরোহণ করতে পারবে ট্রেনে। এছাড়া নিরাপদে যাত্রী পরিবহনের জন্য নতুন ট্রেন পরিচালনা, নাশকতা প্রতিরোধ, টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, লোকোমোটিভ সরবরাহ এবং ছুটি বাতিলসহ অন্যান্য পদক্ষেপও নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

যাত্রীদের নিরাপত্তা ও ভ্রমণের সব প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। তিনি বলেন, ‘গত ঈদের তুলনায় এবার প্রায় ৫০ হাজার বেশি যাত্রী পরিবহনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। আশা করি, নিরাপত্তার মাধ্যমে যাত্রীরা নিজ নিজ বাড়িতে ঈদ করতে যেতে পারবে। ইতোমধ্যে ফিরতিসহ ঈদযাত্রার অগ্রিম টিকিট বিক্রি শেষ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।’

এরপরও দুর্ভাবনা কাটছে না রেলযাত্রীদের। সামনে চলে আসছে গত ঈদের দুর্ভোগের দৃশ্য এবং নানা রকম আতঙ্ক। শেষ মুহূর্তে কোচ সংকট এবং ছিনতাই চক্রের উৎপাত বেশ ভাবিয়ে তুলছে এবারো। শিডিউল বিপর্যয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিবার-পরিজন নিয়ে স্টেশনে বসে থাকা এবং ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে ট্রেনে পা ফেলার মতো অবস্থা না থাকায় যাত্রাপথ যে কী দুর্ভোগের, সেই উদ্বেগ পেয়ে বসেছে এখনই। বিশেষ করে যাত্রাপথে নিরাপত্তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তায় রয়েছে যাত্রীরা। বিভিন্ন স্থানে রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গত ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে মিলিয়ে মোট ১২ দিনের ঈদযাত্রায় ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয়েছে ৭ জন। চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে আহত হয়েছে ৫০ জন।

এমন অবস্থার মধ্যেই আগামীকাল থেকে ঈদযাত্রায় ঘরমুখী মানুষের মূলস্রোত নামবে পথে। পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের রেলেও চাপবে মানুষ। অবশ্য রেলের এবারকার প্রস্তুতিতে কিছুটা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রস্তুতি ভালো। তবে ব্যবস্থাপনাটা ভালো হতে হবে। বিশেষ করে যাত্রাপথে নিরাপত্তার ওপর জোর দিতে হবে।

রেল মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে খোঁজ নিয়ে ঈদযাত্রায় রেলপথের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এ বছর ২৭ জুন মঙ্গলবার ঈদুল ফিতরের সম্ভাব্য দিন ধরা হয়েছে। তিন দিনের সরকারি ছুটি শুরু হচ্ছে ২৬ জুন সোমবার থেকে। অর্থাৎ, ঈদের সরকারি ছুটি থাকবে সোম, মঙ্গল ও বুধবার। এর আগে শুক্র এবং শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে কার্যত ছুটি শুরু হবে ২৩ জুন শুক্রবার থেকে। এই হিসাবে ২২ জুন থেকে মূলত ঈদে বাড়ি ফেরা শুরু হবে মানুষের।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো যাত্রী পরিবহন করা হয়ে থাকে। কিন্তু ঈদে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করে। সারা দেশে রেলের মোট ট্রেন সার্ভিসের সংখ্যা ৩৪২। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ২০১টি এবং পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেন সংখ্যা ১৪১টি।

কোচ সংকট থেকেই যাচ্ছে : নতুন ট্রেন এবং কোচ সংযোজনের পরও গত ঈদের মতো এবারো কোচ সংকট থেকেই যাচ্ছে। সাধারণ সময়ে যেখানে একটি আন্তঃনগর ট্রেনে কমপক্ষে ১৪টি বগি থাকার কথা, সেখানে এই ঈদেও থাকছে গড়ে ৭-৮টি। বগি সংকটে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ট্রেনযাত্রী ভ্রমণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এবারো। রেল মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, রেলওয়ের দুই অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ২৬৮টি যাত্রীবাহী বগি কম নিয়ে বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল করছে। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে ৮৮টি আন্তঃনগর এবং ১৮০টি মেইল ও লোকাল ট্রেন বগি কম নিয়ে চলাচল করছে। প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে কমপক্ষে ১৪টি এবং সর্বোচ্চ ১৭-১৮টি বগি থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে কোনো কোনো আন্তঃনগর ট্রেন ৩টি থেকে ৬টি বগি নিয়ে চলছে। কয়েকটি ট্রেন মাত্র ১০-১২টি বগি নিয়ে চলাচল করছে। এছাড়া লোকাল এবং মেইল ট্রেনগুলোও প্রায় শতাধিক বগি কম নিয়ে চলছে। বিশেষ করে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে এবার কোচ সংকট তীব্র। সূত্রমতে, নিয়মিত সংকটের সঙ্গে নতুন করে ২২টি কোচ সংকট দেখা দিয়েছে। ঈদযাত্রায় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিশেষ ব্যবস্থায় ৮৬টি অতিরিক্ত কোচ যুক্ত করছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। কিন্তু গত মাসেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে ৫৯টি নিয়মিত কোচ। ফলে শেষ পর্যন্ত কোচ সংকট থেকেই যাচ্ছে।

নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় : যদিও নাশকতা প্রতিরোধ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন, চলন্ত ট্রেনে, স্টেশনে বা রেললাইনে নাশকতামূলক কর্মকা- প্রতিরোধে আরএনবি, জিআরপি এবং রেলওয়ের কর্মচারীদের কার্যক্রম আরো জোরদার করা হবে; এছাড়া র‌্যাব, বিজিবি, স্থানীয় পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় নাশকতাকারীদের কঠোরভাবে দমন করা হবে; কিন্তু সংকট থেকেই যাচ্ছে নিরাপত্তাকর্মীর। রেলওয়ের সূত্রমতে, বর্তমানে রেলপুলিশের দুটি জোন রয়েছেÑ চট্টগ্রাম জোন ও সৈয়দপুর জোন। এই দুটি জোনে দুইজন পুলিশ সুপার পুলিশ প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুর—উভয় জোনে ১২টি রেলওয়ে থানা, ১৭টি ফাঁড়ি এবং ৪টি সার্কেল রয়েছে। একজন ডিআইজির নেতৃত্বে রেলপুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানটির মোট জনবল ১ হাজার ৬০৪ জন। আর ১১৯ কিলোমিটার পথের জন্য একটি থানা। তারা দায়িত্ব পালন করবে ৫৮টি রেলস্টেশনে। স্টেশনের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করবে নৈশকালীন একপ্রেস ট্রেনগুলোতে। অথচ সারাদেশে রেলওয়ের স্টেশন আছে ৪৪৩টি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় গতবারের মতো এবারকার ঈদেও রেলপথে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। এই সংকট কাটাতে অন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে জনবল ধার করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঈদযাত্রায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন আড়াইশ’র বেশি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করলেও যাত্রী নিরাপত্তায় থাকবে মাত্র কয়েকশ’ পুলিশ। শুধু আন্তঃনগর এবং অভিজাত ট্রেনগুলোতেই থাকবে পুলিশ পাহারা। পাহারারত পুলিশের সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো নয়; মাত্র ২ থেকে ৫ জন। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এই অবস্থা বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে রেলপুলিশ বিশেষ সতর্ক বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেলপুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। অস্থিতিশীল যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারবেন যে কেউ।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা : যাত্রীদের ভোগান্তি এড়াতে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের তাগিদ দিয়েছেন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান। তিনি বলেন, তুলনামূলক আরামদায়ক এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় রেলের প্রতি যাত্রীদের ঝোঁক বরাবরই একটু বেশি। দেশে মোট ১ হাজার ৮০৮ কিলোমিটার মিটারগেজ এবং ৪০৯ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইনে মোট ৩৪২টি রেল চলাচল করে। গড়ে প্রতিদিন দেড় লাখ যাত্রী চলাচল করে রেলপথে। আর ঈদ মৌসুমে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখে। আর শেষ তিন দিনের সংখ্যার হিসাব দেওয়া তো একেবারেই সম্ভব নয়। ফলে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে সার্বিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়বে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার জানান, রেল বছরজুড়ে নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে চলে। ঈদেও সেই ঝুঁকি থেকেই যায়। ট্রেনের ইঞ্জিন বা ছাদে ভ্রমণ, অবৈধ ক্রসিং, রেলক্লিপ চুরি এবং গেটম্যানসংকট থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমেনি। অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি এবং সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র চলন্ত ট্রেনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ট্রেনে অভিনব পদ্ধতিতে যাত্রীদের ব্যাগ ও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। রেললাইনের দু’পাশে বাজার, বস্তি ও অবৈধ স্থাপনা রয়েছে এবং সেখানে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। আলো এবং প্রয়োজনীয় সিসিটিভিসহ নানা রকম ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। ঈদে এসব ঝুঁকির প্রবণতা আরো বাড়ে। সুতরাং এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।

নগরবিদ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক জানান, দেশে প্রায় আড়াই হাজার লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১১ শতাধিক অবৈধ ক্রসিং। এগুলোতে আবার প্রয়োজনীয় গেটম্যান বা সতর্কীকরণ সাইনবোর্ডও নেই। ঈদে ব্যাপক চাপ থাকায় এসব রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক স্থানে রেললাইন থেকে ইলাস্টিক রেলক্লিপ, ফিশপ্লেট ও নাট-বল্টু চুরি হয়ে গেছে। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রায় ৭৫ শতাংশ ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এই ত্রুটিপূর্ণ রেললাইনের কারণে। ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেশি না হলেও তা যাত্রী দুর্ভোগ এবং রেলওয়ের লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, ট্রেন লাইনচ্যুত হলে সিডিউল বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ লাইনগুলো মারাত্মক দুর্ঘটনারও কারণ হতে পারে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদযাত্রা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist