বিশেষ প্রতিনিধি
মিলছে না আশানুরূপ সাড়া
এবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ!
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে কিনা, থাকলে কিভাবে থাকছে, সেই বিষয়টি প্রতি বছরই বাজেটের আগে ঘুরেফিরে আসে। এবারও বাজেট ঘোষণার আগমুহূর্তে একইভাবে এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী যদিও মুখে বলছেন, আগামী বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে না, কিন্তু বরাবরের মতো সেই ‘তবে’ শব্দটি যুক্ত করে এবারও বলছেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হবে। ফলে এবারও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে- এখন পর্যন্ত এটা বলা যায়।
এ নিয়ে ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। একদিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আবারো চাইছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত। নতুবা এই অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন সময়ে এই সুযোগের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বার বার এ ধরনের সুযোগ অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা এবারো প্রাক-বাজেট আলোচনায় সরকারকে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আনার কৌশল খোঁজার পরামর্শ দিচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও বিনিয়োগের মাধ্যমে টাকা সাদা করার আগ্রহ নেই কালো টাকার মালিকদের। কিন্তু এরপরও প্রতি বাজেটেই এই সুযোগ রাখা হচ্ছে। আর এ কারণেই দেশে দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে উঠছে। যেহেতু সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কর দিয়ে অবৈধ টাকা বৈধ করার সুযোগ দিচ্ছে, সেহেতু এ ধরনের লোকেরা আরো বেশি অন্যায় কাজে উৎসাহিত হচ্ছে। সরকারগুলোর মধ্যে নির্বাচনী বছরে কালো টাকা সাদা করতে দেওয়ার আগ্রহ বেশি লক্ষ করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো কালো টাকার মালিকদের সঙ্গে রাখার জন্য এই সুযোগটি বার বার দিয়ে আসছে। তাই এই সুযোগ বাতিল করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেই অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২১৮ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের পাশাপাশি কালো টাকা সাদা করা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
এবারো থাকছে কিনা : অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ আগামী বাজেটেও থাকছে না। তবে অঘোষিত অর্থ সাদা করার সুযোগ আগের মতোই থাকবে। এ ব্যাপারে গত ১৩ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বাজেট সংক্রান্ত এক আলোচনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বরাবরের মতো এবারো বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না। সাদা করতে চাইলে জরিমানা দিয়েই সাদা করতে হবে।
এর আগে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায়ও কালো টাকা সাদা করা নিয়ে এক ধরনের রাখঢাক ছিল সরকারের। এবারকার মতো একইভাবে জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) সাদা করার যে সুযোগ সরকার দিয়ে আসছে, তা অব্যাহত থাকার কথা বলেছিল।
১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নির্ধারিত করের সঙ্গে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। ওই আইনের দিকে ইঙ্গিত করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া না হলেও জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার যে আইন, তা ভবিষ্যতেও থাকবে। সুতরাং এই আইন বর্তমান সরকার যতদিন আছে, ততদিন বলবৎ থাকবে। ফলে এবারো যে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে, তা ধরে নেওয়া যায়। অথচ ২০১৪ সালে বাজেটোত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আগের বছর (২০১৩-১৪) তিনটি খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সরকার মাত্র ৩৪ কোটি টাকা ট্যাক্স পেয়েছে। যেহেতু ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু ওই সুযোগ তিনি আর দিতে চান না।
সন্তোষজনক সাড়া মিলছে না : সরকার এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও তাতে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি বলে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে এ পর্যন্ত বাজেট ঘোষণা হয়েছে ৪৬ বার। এর মধ্যে ২০ বার রাখা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো এই সুবিধা রাখার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত সাদা হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর এই খাত থেকে সরকার আয়কর পেয়েছে ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ করবর্ষে ১৫৭ জন করদাতা ১৭৬ কোটি ৯০ লাখ কালো টাকা সাদা করেছেন। এর বিপরীতে কর আদায় হয়েছে ২০ কোটি ১২ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ করবর্ষে ২২২ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেছেন। ৬৭৬ কোটি টাকার বিপরীতে এনবিআর কর পেয়েছে ২৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। অপরদিকে, ২০১৫-১৬ করবর্ষের প্রথম তিন মাসে মাত্র ১৬ জন করদাতা ২ কোটি ৯২ লাখ কালো টাকা সাদা করেছেন। এর বিপরীতে এনবিআর কর পেয়েছে ৭৪ লাখ টাকা। তবে দেশে কালো টাকার পরিমাণ কত, এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই এনবিআরের কাছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে দেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি।
কালো টাকা সাদা করার ব্যক্তির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ জানান, ক্ষমতাশালীরাই কালো টাকার মালিক। প্রভাব খাটিয়ে তারা নিজেদের অর্থ লুকিয়ে রাখছেন। এই শ্রেণীর লোকজন সুযোগ না নেওয়ায় কালো টাকা সাদা করার করদাতার সংখ্যা কমতে পারে।
এছাড়া দুদক এবং কর কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় কালো টাকা সাদা করতে চাইছেন না বলেও মত দিয়েছেন তিনি। এরপরও আসন্ন অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ চান আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা।
রিহ্যাবের প্রথম সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘সাধারণত আমরা দেখছি, এই টাকাটা মালয়েশিয়া বা দুবাই চলে যাচ্ছে। এটি এমন একটি খাত, যার সঙ্গে অনেকগুলো খাত জড়িত। এজন্য আমরা বলি, এই খাতে বিনিয়োগ করা যায়।’
তবে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, এবার হাউজিং এবং আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এর ফল হবে আরো ভয়াবহ। কারণ, এই খাতে এমনিতেই কালো টাকা এবং অসৎ? লোকদের দাপট। তার ওপর যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই খাতে কালো টাকাকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সৎ? মানুষ এবং যাদের কালো টাকা নেই, তারা ভিড়তে পারবেন না। সাধারণ মানুষের জন্য আবাসন ব্যবস্থা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ: বিপুল অঙ্কের অবৈধ অর্থ মূল অর্থনীতির বাইরে থাকলেও তা সাদা করার সুযোগ আর না রাখার পক্ষে অর্থনীতিবিদরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অন্যায়, অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য। এটা বাতিল করা উচিত। এতে সৎ করদাতাদের অসম্মান করা হয়। কালো টাকা সাদা করার বিধান থাকলেও তা খুব বেশি হয় না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, বিশেষ উদ্যোগে, বিশেষ ব্যবস্থায় এক-দুই বছরের জন্য দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটা অবিরাম চলতে দেওয়া ঠিক নয়। যদি এটা চলতে থাকে, তাহলে কর না দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা চলতেই থাকবে। এটা তো অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। কালো টাকার ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতি বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।
অধ্যাপক আবু আহমেদ জানান, সরকার বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে এলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বপ্রণোদিত হয়ে এই সুযোগ কাজে লাগাতে আসছে না। প্রকৃতপক্ষে যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের টাকা বিনিয়োগ করত, তাহলে দেশের অর্থনীতি কিছুটা হলেও উপকৃত হতো। বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় দুর্নীতিপরায়ণরা উৎসাহিত হচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন।
এমনকি কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকেও অবৈধ বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সৎ? উপায়ে উপার্জন করে মানুষকে বেশি কর দিতে হচ্ছে। আর অসৎ? উপায়ে উপার্জন করে তা নামমাত্র কর দিয়ে বৈধ করা হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রে এবং সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে, যা সুশাসনবিরোধী।
পিডিএসও/হেলাল