প্রতীক ইজাজ

  ২২ মে, ২০১৭

বাজেটে এবারও বরাদ্দ পাচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকা

অনিয়ম-দুর্নীতিতে সরকারি ব্যাংক

নানামাত্রিক অনিয়মের কারণে দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। একের পর এক আর্থিক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও অব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলোয় দিনের পর দিন খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ও নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি বেড়েই চলছে। অথচ এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর না করে বছরের পর বছর বাজেটে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে সরকার।

যদিও সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংকে টানা দুই বছর মূলধন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এ ছাড়া ঘাটতির এক বছর পর থেকে জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তি কার্যকরের বিধান রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধেই তেমন কোনো জোরালো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সরকারকে। এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক চাপের কারণে পর্যবেক্ষক বসিয়েও অনিয়ম ঠেকাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

ঠিক এমন অবস্থাতে জনগণের করের অর্থ থেকে আবারও বরাদ্দ রাখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে রাখা হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকার তহবিল। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটেও এ খাতে সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। তবে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যদিও এই বরাদ্দ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির তুলনায় কম। কারণ এ মুহূর্তে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৫ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সরকারি ব্যাংকে কিছু গন্ডগোল আছে, আমরা সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে মূলধন ঘাটতি পূরণে বরাদ্দ না দিলে এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো চলতে পারবে না।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আর্থিক কেলেঙ্কারি, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপানার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে। এই বিশাল অর্থ উদ্ধারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো জনগণের করের টাকায় এ ঘাটতি মেটাতে যাচ্ছে সরকার। জবাবদিহিতা ছাড়াই প্রতিবছরই দেওয়া হচ্ছে বরাদ্দ। অথচ অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ ছিল-তহবিল দেওয়ার আগে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে হবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে দক্ষতাও।

তার পরও কেন নতুন করে অর্থায়ন করছে সরকার-জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে অর্থায়ন হচ্ছে রাজনৈতিক চাপে। সবটাই হয়েছে সব আমলের ক্ষমতাধরদের নির্দেশ-আদেশে। যার পরিণতিতে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন পরিস্থিত ভীষণ নাজুক অবস্থায় চলে গিয়েছে। সরকারি অর্থে মূলধন ঘাটতি কমিয়ে এনে ওগুলোকে ঠিক বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে মাত্র।

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ব্যাংক সেক্টরের অবস্থা খুবই খারাপ। লুটেরা শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। ওরাই ব্যাংকের সব। মূলত সরকারই এর জন্য দায়ী। সরকারি ব্যাংকগুলো ধ্বংসের জন্য মূলত সরকারই দায়ী। শীর্ষ পদগুলোতে সরকারদলীয় লোকজন নিয়োগ পাচ্ছে। এমনকি পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করছে। সবাই মিলে লুটপাট করছে। আর বছর শেষে বরাদ্দ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নানা অনিয়ম সম্পর্কে জানা গেছে। ব্যাংকগুলো হলো-সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ব্যাংক, বিডিবিএল এবং বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বছরের পর বছর ধরে চলা লুটপাট আর অনিয়ম বন্ধের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের নভেম্বরে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণসহ লোকসান বাড়ছেই।

বাড়ছে খেলাপি ঋণ : সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই। গত ২০১৬ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা। এর পরও গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর বাইরে আরো ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এ তথ্য খেলাপির হিসাবে নিলে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি আট ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা।

এর মধ্যে চার সরকারি ব্যাংক মাত্র এক বছরেই সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে গেছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে জনতা ব্যাংকে। এরপরই রয়েছে অগ্রণী, সোনালী ও রূপালী ব্যাংক। এতে করে ২০১৬ সাল শেষে ব্যাংক চারটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। আর লোকসান গুনছে এমন শাখা বেড়ে হয়েছে ৪৪৬। চার ব্যাংকের নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। একইভাবে বেসিক ব্যাংকে সাত হাজার ২২৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এর পরও অবিশ্বাস্যভাবে আড়াই কোটি টাকার নিট মুনাফা দেখিয়ে আলোচনায় আছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চার হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা বা ২৭ শতাংশের বেশি ঋণ এখন খেলাপি। এক বছর আগে যা ছিল ২৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৭৩০ কোটি টাকা বা মোট ঋণের অর্ধেকই এখন খেলাপি। এক বছর আগে ৪৩ দশমিক ১৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি ছিল। রাজশাহী কৃষি উন্নয় ব্যাংক ৬০৫ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি।

বাড়ছে মূলধন ঘাটতি : এ মুহূর্তে দেশের সাত সরকারি ব্যাংকে মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৫ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি তিন হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৭১৪ কোটি, কৃষি ব্যাংকের সাত হাজার ৮৩ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৭৪২ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ৪২৩ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৭৭১ কোটি টাকা ও অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ২০০ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকদের অভিমত, ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকারও প্রতিবছর শর্তসাপেক্ষে মূলধন ঘাটতি পূরণে টাকা দিচ্ছে। তার পরও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না।

তারা আরো বলেন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে পড়ছে। রাজনৈতিক চাপ ও ব্যাংকে অব্যবস্থাপনার কারণে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। আর এর খেসারত দিতে জনগণের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

আবারও বরাদ্দ : জনগণের করের টাকায় এবারও সরকারি ব্যাংকের অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায় মেটাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটেও সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুুল মুহিত। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা করা হয়। এর আগে গত পাঁচ বছর ধরেই সরকার এ খাতে পাঁচ হাজার টাকা করে বরাদ্দ রেখে আসছে।

উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা : সরকারি ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর না করে বারবার মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ বরাদ্দে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে এ সংকট নিরসনে তারা পরামর্শও দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের উচিত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ না দিয়ে তাদের দক্ষতা ও খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে যারা ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তাই আগামীতে যাতে জনগণের করের অর্থ বরাদ্দ দিতে না হয় সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো ধরনের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ দেওয়া পর্যবেক্ষকের রিপোর্টের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখছে সরকার, যা ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সমস্যা মূলধন ঘাটতি নয়, সমস্যা হলো ব্যাংকে নিয়োজিত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। তাই ব্যাংক পরিচালক নিয়োগে স্বচ্ছতা না আনলে সমস্যা হতেই থাকবে। ফলে সেখানে আগে হাত দেওয়া দরকার। আর মূলধন ঘাটতির ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে বলা দরকার, সরকার নতুন করে অর্থ দেবে না। ব্যাংকগুলোকে ব্যবসায় মুনাফা অর্জন করে তা পূরণ করতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
খেলাপি ঋণ,অনিয়ম-দুর্নীতি,সরকারি ব্যাংক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist