শাহজাহান সাজু

  ১১ আগস্ট, ২০২০

ডলারে আস্থাহীনতায় বাড়ছে স্বর্ণের দাম

সোনার দাম হু হু করে বাড়ছে। পণ্যটির দাম বাড়তে বাড়তে অনেকেরই নাগালের বাইরে চলে গেছে। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চ থেকে সামাজিক অনুষ্ঠান প্রায় বন্ধই বলা চলে। জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরাও বলছেন, নতুন করে সোনার গহনা বানাতে দোকানমুখী হচ্ছেন না ক্রেতারা। এতে সোনার চাহিদা আগের চেয়ে কয়েকগুণ কমেছে। নিয়ম অনুযায়ী চাহিদা কম থাকলে ওই পণ্যের দাম কমে। কিন্তু সোনার ক্ষেত্রে হচ্ছে তার ঠিক উল্টো। কেন এমন হচ্ছে—সেই প্রশ্ন ছিল সংশ্লিষ্টদের কাছে।

এ বিষয়ে দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের ওপর আস্থা হারানো ছাড়াও আর্থিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই সোনা মজুদের ওপর ঝুঁকছেন বিনিয়োগ-কারীরা। এ কারণে সোনার দাম বাড়ছে। তাছাড়া সোনার দাম বাড়ার পেছনে মূল্যস্ফীতিও অন্যতম প্রধান কারণ বলে বলছেন তারা। তাদের মতে, মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ বাড়লে মুদ্রার মান কমে যায়। আর মুদ্রার মান কমে গেলে নগদ অর্থের চেয়ে সোনায় বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অনেকেই। সুদের হারের সঙ্গেও সোনার দামের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সুদের হার কমে গেলে বিনিয়োগকারীর আমানতের ওপর ভালো রিটার্ন পান না। তখনই তারা আমানত ভাঙিয়ে সোনায় বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মুদ্রার মানও সোনার দাম ওঠানামায় প্রভাব ফেলে। এ বিষয়ে তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম ডলারে লেনদেন হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল নয়। এর প্রভাবেও সোনার দাম বাড়তে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সোনার ব্যবহার বাড়ার কারণে যে ধাতবটির দাম বাড়ছে, তা কিন্তু না। সোনার দাম বাড়ছে অন্য কারণে। সেটা হলো আন্তর্জাাতিক বাজারে ডলারের দাম বারবার ওঠানামা করছে। এতে ডলারের দামের স্থিতিশীলতা নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এতে বেশির ভাগ মানুষ বিনিয়োগের নির্ভর-যোগ্য খাত হিসেবে সোনা কিনছেন। ফলে সোনার চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে দামও। তবে এই অবস্থা কত দিন থাকে, তাও দেখার বিষয়। পুরো বিষয়টি ডলারের দাম ওঠানামার ওপর নির্ভর করছে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, করোনার কারণে দেশে সোনার চাহিদা কমে গেলেও এর দাম বাড়ছে। এর প্রধান কারণ বিশ্ববাজারে অস্থিরতা। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম দ্রুত ওঠানামা করছে। এতে ডলারের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এতে সোনার চাহিদা বাড়ছে। এর সঙ্গে দামও বাড়ছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সোনা এক ধরনের কারেন্সি। আন্তর্জাতিক নিয়ম হলো ডলার অথবা সোনা নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ থাকলেই কেবল টাকা প্রিন্ট করা যায়। আর করোনার কারণে পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে সব দেশকে টাকা প্রিন্ট করতে হচ্ছে। যে কারণে পৃথিবীর সব দেশের রিজার্ভ বাড়াতে হচ্ছে। এতে সোনার চাহিদা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছা করলেই টাকা প্রিন্ট করতে পারে না। টাকা প্রিন্ট করতে হলে হয় ডলারের রিজার্ভ থাকতে হবে; নয়তো গোল্ডের রিজার্ভ থাকতে হয়।

বাজুস সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বও এই অস্থিরতা অন্যতম। তাই আমেরিকার নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সোনার দাম কমার সম্ভাবনা নেই বলেই ধারণা করছেন তিনি।

দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা আরো বলেন, দেশের সোনা যাতে দেশের বাইরে না যায়, সেজন্যই দাম বাড়ানো হয়। তার মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ব্যালান্স ঠিক রাখার জন্যই সোনার দাম বাড়ানো হয়। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করার জন্য এটা করতে হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পরও দেশের বাজারে দাম যদি না বাড়ানো হয়, তাহলে দুনিয়ার সব দেশের মানুষ বাংলাদেশ থেকে অল্প দামে সোনা কেনা শুরু করবে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ডলারের দাম যখন পড়ে যায়, তখন সোনার দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে ভারত, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডলারের দাম পড়ে গেছে। তাই চীনসহ বিভিন্ন দেশে অনেকেই ডলার বিক্রি করে সোনা কিনতে শুরু করেছেন। এসব কারণে সোনার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, বিশ্ববাজারে ডলারের মতো সোনা একটি কারেন্সি বা মুদ্রা। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা ও ডলার দুটোই কিনে রাখে এবং ব্যবসা করে। বর্তমানে বিশ্বের বড় দেশগুলোতে ডলারের দাম পড়ে গেছে। ফলে চীনসহ বিভিন্ন দেশে অনেকেই ডলার বিক্রি করে সোনা কিনতে শুরু করেছে। এতে সোনার চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামও বাড়ছে। করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম প্রায় ৫০০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহেই প্রতি আউন্স সোনার দাম বেড়েছে ২৫০ ডলার করে। যে কারণে দেশের বাজারে সোনার চাহিদা কমলেও দাম বাড়ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে না আসায় ঝুঁকিতে রয়েছে ডলার। ফলে পড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। অন্য মুদ্রার বিপরীতে চলতি বছর প্রায় ৮ শতাংশ দর কমেছে ডলারের। করোনার এই অনিশ্চয়তার সময়ে সোনার মতো নিরাপদ পণ্যে বিনিয়োগ বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের। এ বছর সোনার দাম প্রায় ২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

জানা যায়, বর্তমানে দেশের বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) সোনা বিক্রি হচ্ছে ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা। বাজুস গত ৬ আগস্ট থেকে এই দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ে এক ভরি ভালো মানের সোনার দাম ছিল ৫৪ হাজার ৫২৯ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে সোনার ভরিতে দাম বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার ৬৮৭ টাকা।

বাজুসের এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ইউএস ডলারের দরপতন হচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত সোনার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশীয় বুলিয়ন মার্কেটেও সোনার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাজুস,ডলার,সোনা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close