শাহজাহান সাজু

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

পাচার অর্থ ফেরাতে অ্যাকশনপ্ল্যান

তথ্য সংগ্রহের দীর্ঘ সূত্রতায় আটকে আছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর কার্যক্রম। এছাড়া আরো তিন কারণ সামনে এসেছে। এগুলো হচ্ছে ডুয়েল ক্রিমিনালিটি (দ্বিতীয়বার অপরাধ), পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া ও আইনি জটিলতা। তবে এসব বাধা পেরিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে অ্যাকশন প্ল্যান করছে সরকার। নতুন দায়িত্ব পেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)।

সূত্র জানিয়েছে, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে এই প্ল্যান কাজে লাগানো হবে। এর মধ্যে রয়েছে, সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলোতে আর্থিক বা কর গোয়েন্দা সংস্থার লোক নিয়োগ, পাচার অর্থের তথ্য সংগ্রহ, সাইবার ও পর্নোগ্রাফিকে মানি লন্ডারিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করা। এছাড়া এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) কার্যক্রম ২০২৮ সাল পর্যন্ত বর্ধিতকরণে সরকারের সমর্থন ও সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ডাবল ট্যাক্সেশন চুক্তি হালনাগাদ করার উদ্যোগ রয়েছে।

ওই সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স সভায় বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মূলত সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এদিকে অর্থ পাচারের ঘটনার ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও তদন্তের সময় তথ্য পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি দিকনির্দেশনা প্রণয়নের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এনবিআর এই কাজ করছে। মানি লন্ডারিংয়ের মধ্যে সাইবার ও পর্নোগ্রাফিকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সভার কার্য বিবরণীতে বলা হয়, বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ উদ্ধারের ব্যাপারে সম্যক ধারণা লাভে সংশ্লিষ্ট দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময় করার দরকার। এজন্য ওইসব দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলোতে স্বল্প সময়ের জন্য (এক থেকে দুই মাস) আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের বা কর গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তাদের পাঠাতে হবে। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

অর্থ পাচার প্রতিরোধকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এপিজির কার্যক্রমের মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হবে। এজন্য সদস্য দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীর সমর্থনের প্রয়োজন হয়। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত সমর্থনে একটি সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে এপিজি এশিয়া অঞ্চলে ১৯৯৭ সাল থেকে কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানটি ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) সংস্থা।

অর্থমন্ত্রীর অনুমোদিত সার সংক্ষেপে বলা হয়, এপিজির সদস্য দেশ বাংলাদেশ। এর সব ধরনের কর্মকা-ে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে থাকে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। পাশাপাশি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া বাংলাদেশ এপিজির কো-চেয়ারের দায়িত্ব পালন করে আসছে। এজন্য ২০২৮ সাল পর্যন্ত এপিজির কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমর্থন হিসেবে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন।

জানা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (দেশি মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির তথ্য মতে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের চলতি বছরের (২০১৮-১৯) জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত বুধবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশি কর্মী নিয়োগের ফলে বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করেন। যার মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী বৈধ কর্মী রয়েছেন ৯০ হাজার। এদের ন্যূনতম গড় মাসিক বেতন দেড় হাজার মার্কিন ডলার। সে হিসেবে বিদেশি কর্মীদের বার্ষিক আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৩০ শতাংশ স্থানীয় ব্যয় বাদে প্রায় ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে বৈধভাবে বিদেশে যায় ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। টাকার অঙ্কে প্রায় ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর বার্ষিক রাজস্ব ক্ষতি হয় ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ১২ হাজার কোটি টাকা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এনবিআর,অ্যাকশনপ্ল্যান,অর্থ পাচার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close