গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২০

ক্ষুদ্র গ্রাহকদের স্বপ্ন কেড়ে নিল ‘সান’

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগের জমানো অর্থে বড় স্বপ্ন বুনতে চেয়েছিল সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মির্জাপুরসহ কয়েকটি গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাদের এই স্বপ্নপূরণে পাশে এসে দাঁড়ায় ‘সান’ নামে বেসরকারি একটি এনজিও। ৯০-এর দশকে সীমিত পরিসরে আমানত সংগ্রহ শুরু হয়। আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের সহজ-সরল নারীদের হৃদয় কাড়ে। এটা অব্যাহত থাকে লক্ষ্য অনুযায়ী গ্রাহক সংগ্রহ পর্যন্ত। লক্ষ্যে পৌঁছে পিছুটান শুরু হয় এনজিওটির।

২০০১ সালে আমানত ফেরত দেওয়া নিয়ে এনজিওটি প্রথমে গ্রাহকের মুখোমুখি হয়। একপর্যায়ে তারা গ্রাহকের আমানত সংগ্রহ ও ফেরত দুটিই বন্ধ করে দেয়। তখন এটির নির্বাহী পরিচালক ছিলেন আজিজুল ইসলাম। সময়ের পরিক্রমায় পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে আজিজুল ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশ করে এনজিওর নির্বাহী পরিচালনার দায়িত্বে আসে তালার জগদানন্দকাটি গ্রামের বাসিন্দা ক্ষেত্রমজুর গোবিন্দ দাশের ছেলে সাগর দাশ। স্থানীয় ছেলে সানের পরিচালক হওয়ায় গ্রাহকরা খুশিই হয়েছিলেন। টানা কয়েক বছর ঋণ দেওয়া-নেওয়ায় দ্রুত কার্যক্রম চালায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তালার মির্জাপুর গ্রাম, কেশা, বারাত, হাতবাস, নোয়াকাটিসহ সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের পাশের গ্রামের বিভিন্ন কেন্দ্রে গত ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সঞ্চয় সংগ্রহ করেছে। এরপর থেকে সব কার্যক্রম কর্তৃপক্ষ থামিয়ে রেখেছে। মির্জাপুর গ্রাম থেকে অফিসও উধাও। তখন থেকেই গ্রাহকের ভিড় জমতে থাকে সাগর দাশের বাড়িকে ঘিরে। এতেও সুফল মেলেনি। তাকে বিশ্বাস করে এখন গ্রাহকরা সর্বস্বান্ত। তাদের স্বপ্নপূরণ তো দূরের কথা বিনিয়োগ করা আমানত ফিরে পাওয়াই এখন দায় হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, ‘সান’ নামে এনজিওর গ্রাহকের সংখ্যা তিন শ। গ্রাহকের সঞ্চয়ী আমানত ৩০ লাখ টাকা। তবে ঋণ দেওয়া-নেওয়ায় এ সঞ্চয় অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়েছে। টাকার অঙ্ক বাড়াতে ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে সাগর দাশ। গ্রাহকের টাকায় তিনি এখন নিজের সাজসজ্জা বাড়িয়েছেন। চেষ্টা চালাচ্ছেন কৌশলে দেশত্যাগের। কারণ সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ার সুবাধে ভারতে যাওয়াটা ঢাকায় আসার তুলনায় অনেক সহজ। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের কথা চিন্তা করে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে প্রায় ২৮ বছরে জমানোর পুরো টাকাই হারাবেন তারা।

ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা বলেন, সংস্থাটি পোলট্রি ও সেলাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহক তৈরি করা শুরু করে। তালার মির্জাপুর গ্রাম দিয়ে শুরু করে পর্যায়ক্রমে জগদানন্দকাটি, বারাত, কেশা, বকশিয়া, নোয়াকাটিকে আওতায় নিয়ে আসে। পরে ধানদিয়া ইউনিয়নের মানিকহার, ফুলবাড়ি, সেনেরগাতিসহ বেশ কিছু গ্রামেও কার্যক্রম শুরু করে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম সান এনজিওর আওতায় চলে আসে।

গ্রাহক সংখ্যা টার্গেটে পৌঁছানোর পর ধীরে ধীরে প্রতারণার পথে হাটা শুরু হয় ‘সান’ এনজিওটি। প্রথমে সাগর দাশের নিজ এলাকার বাইরে ধানদিয়া-ফুলবাড়ি এলাকার এক শ থেকে দেড় শ গ্রাহকের সঙ্গে ঋণ দেওয়া এবং আমানত সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন এলাকার বঞ্চিতরা মির্জাপুরে এসে সান এনজির কর্তৃপক্ষের খোঁজ করতে থাকলে এখানকার গ্রাহকদের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় দেখা দেয়। মির্জাপুর গ্রামের গ্রাহকরা দূরের গ্রাহকদের সঙ্গে একত্র হতে থাকলে সুচতুর সাগর দাশ নিজেকে সব কার্যক্রম থেকে গুটিয়ে নেন। গ্রাহকদের মিথ্যা আশ্বাস এবং নানা প্রলোভন দেখিয়ে কিছুদিন চুপচাপ রাখেন। সব আশা শেষ হলে গ্রাহকদের মধ্যে গণবিস্ফোরণ ঘটে। এখন সাগর দাশ পুরো অর্থ নিয়ে লাপাত্তা হতে তৎপর হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফুলবাড়ি ও মির্জারপুর গ্রামের এক গ্রাহক বলেন, বাবার ঘর থেকে বিয়ের সূত্রে স্বামীর বাড়িতে আসার পর নিজে স্বাবলম্বী হতে সঞ্চয়ের মনোভাব তৈরি করি। পাশের বাড়ির ভাবির সহায়তায় এনজিও ‘সান’-এর সন্ধান পাই। নাম লেখানোর পর এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হই। কিছু টাকা জমলে ঋণ চাইলে তা বাড়িতে এসে পৌঁছে দিতে থাকে। এতে আরো উৎসাহী হয়ে অভাবী অন্যান্য ভাবি-আপাদের এ কাজে যুক্ত করি। একটা বড় সঞ্চয়ের স্বপ্ন দেখার আগেই সব শেষ। এখন শুধু হতাশা।

মির্জাপুরের গ্রামের একাধিক গ্রাহক জানান, সাগর দাশ আমাদের জমানো টাকার লাভসহ ফেরত দেবেন— এ প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় দুই বছর আমাদের দমিয়ে রাখেন। কিন্তু কোনো টাকা ফেরত না পেয়ে এখন আমরা সর্বস্বান্ত। অন্য একজন বলেন, জুতার তলা খুইয়েও এক টাকা আদায় করতে পারেনি। আরেকজন বলেন, সাগর কাউকে টোপ দিচ্ছে টাকা ফেরত দিতে দেরি হবে। আবার কাউকে বলেছে, তিন ভাগের একভাগ দেব। আবার কাউকে বলছে, অর্ধেক দেব। বাকি টাকা আর পাব না মর্মে সব পরিশোধ হিসেবে স্ট্যাম্পে লিখে দিতে বলছে। এখন আমরা কী করব ভাবতেও পারছি না।

ছোটবেলায় কষ্টে জীবনযাপন করা সাগর দাশ ফার্মেসিতে মাসিক বেতন-ভাতায় চাকরি করার সুবাধে নিজে একজন হাতুড়ে চিকিৎসক বনে যান। এরপর ডেসটিনি করে গ্রামের অনেক মানুষের অর্থ হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার এনজিওর নির্বাহী পরিচালক হয়ে আরো বড় অর্থ হাতিয়ে নিতে তৎপরতা শুরু করেছেন। মির্জাপুর বাজারে নিজের নামে কয়েকটি দোকান আছে। পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন। ভাইদের নামে এনজিওর টাকায় জমি কিনেছেন। এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছেÑ সম্পদ বিক্রি করে তিনি দেশত্যাগ করবেন যেকোনো সময়।

গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাগর দাশ বলেন, তিন শ গ্রাহকের মধ্যে অর্ধেক গ্রামের ১২ লাখ টাকা আমার জিম্মায় রয়েছে। চেষ্টা করছি টাকা গ্রাহককে ফেরত দেওয়ার। তবে, কত দিনে ফেরত দিতে পারব, এটা বলতে পারব না। সমস্যা হয়েছে, এখন গ্রাহকদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে দেশত্যাগের বিষয়টি তিনি সরাসরি নাকচ করেন।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আামি অবগত ছিলাম না। একটি মাধ্যমে জেনেছি। খবরটি জানার পর স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা এনজিওটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করলে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা সমাজসেবা অফিসার দেবাশীষ রায় বলেন, আমি খোঁজখবর নিচ্ছি। তারপর বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সান সংস্থার অর্থ আত্মসাৎ প্রসঙ্গে পাটকেলঘাটা থানার ওসি কাজী ওয়াহিদ মোরশেদ এ প্রতিবেদককে জানান, এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। কোনো অভিযোগও পায়নি। পেলে ব্যবস্থা নেব।

উল্লেখ্য, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) আইন-২০০৬-এর ১৫ ধারা অনুযায়ী এ নির্দেশ দেওয়া হয়। দেশে কোনো এনজিও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করতে চাইলে তাদের আলাদা করে এমআরএর অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান কোনো অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম করছে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এনজিও,সান,সাতক্ষীরা,গ্রাহকের টাকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close