নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৯

কেজি ২২০ টাকা

পেঁয়াজে নাভিশ্বাস

অনেক উদ্যোগ, আশ্বাস আর পদক্ষেপেও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে এলো না পেঁয়াজের বাজার। দামের পাগলা ঘোড়ার রাস যেন কিছুতেই টেনে ধরতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। উল্টো কেজিপ্রতি বাড়ল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এ নিয়ে গত চার মাসে পেঁয়াজের দাম বাড়ল ২৫ বার। বলা যায়, দামে রেকর্ড গড়ল পেঁয়াজ।

বৃহস্পতিবার দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দাম বাড়ার পেছনে সরকারকে দায়ী করছেন ক্রেতারা। এর কারণ হিসেবে তারা বাজার, আমদানিকারক ও পাইকারদের তদারকি না করাকে দুষছেন। আর বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোক্তাদের সঙ্গে আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতাদের প্রতারণার কুফল এটি।

গতকাল কারওয়ানবাজারে দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ২০০ টাকা কেজি, মিসরের ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, মিয়ানমারের ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর আগে গত বুধবার প্রতি কেজি ভালোমানের দেশি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কোথাও কোথাও একই মানের পেঁয়াজ ১৫০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, মিসরের ১৩০ টাকা এবং তুরস্কের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। অথচ গত মঙ্গলবারও এই পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কম ছিল।

পেঁয়াজের বাজারের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে গত মঙ্গলবার সংসদে এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ হুমায়ূন বলেন, আমি বিশ্বাস করি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পেঁয়াজের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আকস্মিক বন্যার কারণে ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের পেঁয়াজের বাজার গরম হয়ে ওঠে। তবে আমরা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি। বর্তমানে আমরা মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছি।

এ দিন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির অনুপস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী সংসদে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি আরো বলেন, এই মৌসুমে পেঁয়াজ কম উৎপন্ন হয় ও এই সময়ে সাধারণত সংকট থাকে। তবে কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের বাজারে দেশি পেঁয়াজ চলে আসবে।

শিল্পমন্ত্রীর এই বক্তব্যের দুই দিন পর গতকাল দুপুরে কারওয়ানবাজারে পেঁয়াজ কিনতে এসে গৃহবধূ রোজিনা আক্তার দেখেন, পেঁয়াজের দাম কমেনি তো বটেই বরং সেটি আরো বেড়েছে। ক্ষোভে-দুঃখে রোজিনা বলেন, পেঁয়াজের দাম যেভাবে বেড়ে চলছে তাতে তো মনে হচ্ছে পেঁয়াজ খাওয়াই ছেড়ে দিতে হবে।

মশিউর রহমান নামের এক ক্রেতা বলেন, পেঁয়াজের বাজারে সরকারের নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার, না হলে এই দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

বিক্রেতাদের দাবি, বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলেই বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন তারা। সুমিল নামের একজন পাইকারি বিক্রেতা বলেন, পেঁয়াজের আমদানি কম চাহিদা বেশি, প্রতিদিন চাহিদা যদি হয় ২০ ট্রাক, পাই এক-দুই ট্রাক, তাহলে কেমনে হবে বলেন!

পাইকারি বিক্রেতা বাচ্ছু মিয়া হতাশা ব্যক্ত করেন বলেন, যেভাবে বাজার চলছে তাতে ঘর-দোকান-কর্মচারীর খরচ উঠানোই কষ্টকর হয়ে পড়ছে। সংসার চালানো তো পরের কথা। পেঁয়াজের বাজারের এই ‘নৈরাজ্য’ দ্রুত বন্ধের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে নানা বাহানা, নানা উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের দাম প্রতিদিন বাড়িয়ে চলছে ব্যবসায়ীরা। গত চার মাস ধরে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে মোট ২৫ বার। ৩০ টাকা থেকে শুরু করে কখনো ৫০, ৯০, ১২০, ১৫০, ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। এবার তা ডাবল সেঞ্চুরি অতিক্রম করল। বর্তমানে পেঁয়াজ ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা সবসময়ই সুযোগ সন্ধানী। অতি মুনালোভী ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই তা লুফে নেন। সেটি যৌক্তিক না অযৌক্তিক, সে বিষয়ে মাথা ঘামান না-এটি ঘোর অন্যায়। ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন তারা। কেবল রাজধানীতে নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পেঁয়াজের বাজারে আগুন।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ও জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিদের বৈঠকে পেঁয়াজের মূল্য কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রির আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম কমার লক্ষণ নেই। গতকাল চট্টগ্রামে খুচরা পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ক্যাবের চট্টগ্রাম সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ব্যবসায়ীদের আশ্বাসের পরও কেন মূল্য কমছে না তা বোধগম্য নয়, এটা আমাদের ও জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমদানিকারকরা আমদানির নামে কালক্ষেপণ করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের আমদানির দিকে না তাকিয়ে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানির বিষয়টি আমি আগেই প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেটি করা গেলে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসত।

রানীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান, পেঁয়াজের দাম বেড়ে ১৮০ টাকায় পৌঁছেছে। কয়েক দিন আগে পাইকারি পেঁয়াজ জেলা শহরের আড়ত থেকে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু বুধবার থেকে আবার পেঁয়াজের দাম পাইকারি বেড়ে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায় ঠেকেছে। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা তা কিনে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি করছে। সর্বশেষ গতকাল ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

পলাশ (নরসিংদী) প্রতিনিধি জানান, মাত্র একদিনের ব্যবধানে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। গতকাল প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা করে।

ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, ২০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রির অভিযোগে পাঁচ ব্যবসায়ীকে ২ হাজার করে মোট ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাসরীন পারভীন গোবিন্দাসী বাজারে অভিযান চালিয়ে এই জরিমানা করেন।

নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, গতকাল অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেশি পেঁয়াজের দাম ১৮০ টাকায় পৌঁছেছে। ক্রেতাদের অভিযোগ সরকারের নিয়মিত মনিটরিং না থাকায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন।

হিলি (দিনজাপুর) প্রতিনিধি জানান, হিলি স্থলবন্দরে এক লাফে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে। যে পেঁয়াজ গত বুধবার বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৩০ থেকে থেকে ১৪০ টাকা। সেই পেঁয়াজ গতকাল প্রকারভেদে বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। আমদানিকারকরা বলছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় দাম বেড়েছে। পেঁয়াজ কিনতে আসা পাইকাররা জানান, বাজার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন তারা। অনেকেই দাম বেশির কারণে পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাজার,পেঁয়াজ,দাম বৃদ্ধি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close