শাহজাহান সাজু

  ৩১ মার্চ, ২০১৯

অর্থ পাচার রোধে নানামুখী পদক্ষেপ

ওভার ইনভয়েসিংয়ে এবার কড়া নজরদারি

ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে ওভার ইনভয়েসিং করা হয়। এ কারণে যারা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানি করছেন তাদের খুঁজে বের করার এবং তাদের দিকে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

এছাড়া ট্যাক্স ফাঁকি দিতে হুন্ডি ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার করা হয়। অর্থ পাচার রোধে দেশের সব বন্দরে স্ক্যানার মেশিন স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছে সরকারের গঠিত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধসংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) স্ক্যানার স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে সব ধরনের পণ্য পরীক্ষা করতে হবে। সম্প্রতি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আরো বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জানা যায়, দেশ থেকে কী পরিমাণ টাকা পাচার হয় সেই হিসাব সরকারিভাবে না মিললেও যুক্তরাষ্ট্রের জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, এর পরিমাণ বছরে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেশ থেকে এই টাকা চলে যাচ্ছে চার প্রক্রিয়ায়। এগুলো হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং, হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। এর মধ্যে টাকা পাচারের সবচেয়ে সহজ নিরাপদ ও বড় মাধ্যম হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিং।

বৈঠকে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের (এপিজি) আসন্ন বৈঠকে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে বাংলাদেশের অবস্থান মূল্যায়ন করা হবে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার কার্যক্রমের মূল্যায়ন হবে। ফলে এসব ক্ষেত্রে আমাদের রেটিং উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে কাজ করতে হবে। সংশিষ্ট সূত্র জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে টাকা পাচারের বিষয়ে বৈঠকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন দুদকের প্রতিনিধি। এ সময় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের বিষয়ে তিনি এনবিআরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমদানি ও রফতানির জন্য ঘোষণা করা সব ধরনের পণ্য যাচাইয়ে সব বন্দরে স্ক্যানার মেশিন স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, অর্থ পাচার রোধে ওভার ইনভয়েসিং কিংবা অন্য উপায়ে ঘোষণা করা আমদানি-রফতানি পণ্য পরীক্ষার জন্য সব বন্দরে স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বশেষ প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (দেশীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। সংস্থাটির মতে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের চলতি বছরের (২০১৮-১৯) জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

জানা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) বার্ষিক বৈঠক আগামী আগস্টে অনুষ্ঠিত হবে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে বাংলাদেশে কী ধরনের কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে ওই বৈঠকে মূল্যায়ন করা হবে। এজন্য এপিজির কাছে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন বা অ্যাকশন প্ল্যান পাঠাতে হবে। ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনা করা হয়।

সূত্র জানায়, মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রেটিং উন্নয়নে এপিজি কিছু সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে সরকার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বলা হয়।

এদিকে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক অ্যান্ড কোম্পানির ক্ষমতা ও আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ এর সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে এর অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি মিউচুয়াল ইভালুয়েশনের সুপারিশের আলোকে বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়ের অগ্রগতিও জানতে চাওয়া হয়। আর এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য বিএফইইউ এবং রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির সঙ্গে বৈঠকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এসব বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য বিএফইইউ-এ সরবরাহ করতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, এপিজি হচ্ছে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (মানিলন্ডারিং) ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থার (এফএটিএফ) আঞ্চলিক সংস্থা। এর কাজ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনি দুর্বলতা ও ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া এবং সেটা বাস্তবায়নে সহায়তা করা। ১৯৮৯ সালে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সংস্থাটি মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করে আসছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ওভার ইনভয়েসিং,নজরদারি,অর্থ পাচার,মানি লন্ডারিং
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close