নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

কেমন হবে কর্ণফুলী টানেল

কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে অন্তত ৪০ মিটার গভীরতায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যাবে কর্ণফুলী টানেল। ওই গভীরে কী কর্মযজ্ঞ শুরু হতে যাচ্ছে তা আঁচও করতে পারবে না কর্ণফুলীর হাজার হাজার সাম্পানওয়ালা, জেলে আর মাঝি-মাল্লা। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্টে বসানো হয়েছে টিবিএম মেশিন, যা নদীর তলদেশে কর্ণফুলী টানেলের খননকাজ চালাবে।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, এ প্রকল্পে দেশি-বিদেশি প্রায় এক হাজার ২০০ লোক তিন শিফটে কাজ করছেন। এরইমধ্যে নদীর দুই অংশে প্রকল্পের ২৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খনন কাজের উদ্বোধনের পরপরই শুরু হবে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ তৈরির কাজ।

কর্ণফুলী টানেলের দৈর্ঘ্য হবে তিন দশমিক চার কিলোমিটার। নদীর তলদেশ দিয়ে দুটি টিউবে চার লেন টানেল সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। নদীর পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাশের সংযোগ সড়কসহ এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে ৯ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, টানেল দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চালুর তিন বছর পর ওই সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখে। চালুর প্রথম বছরে চলাচল করা গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কন্টেইনারবাহী ট্রেইলর এবং বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাস এবং ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোট গাড়ি থাকবে।

ইতোমধ্যে চীন থেকে আনা টিবিএম মেশিন পরীক্ষামূলক খনন কাজ সফলভাবে শুরু করেছে। প্রায় তিনুলা বাড়ির সমান উঁচু দৈত্যাকৃতির এ টিবিএম কর্ণফুলীর পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে মাটি কেটে কেটে এগিয়ে যাবে, যা কোনো কোনো পয়েন্টে নদীর তলদেশের মাটি থেকেও ১৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত পাতালে ঢুকবে, যার মধ্য দিয়ে তৈরি হবে সুড়ঙ্গ পথ। মেশিনটি নদীর উত্তর প্রান্ত থেকে পথ কাটা শুরু করে দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বের হবে।


আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খনন কাজের উদ্বোধনের পরপরই শুরু হবে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ তৈরির কাজ


প্রকল্পের প্রকৌশলীরা জানান, টিবিএম মেশিনের ঠিক সামনে আছে ধারালো কাটার, যা মাটি কাটতে কাটতে এগিয়ে যাবে। কাটার মেশিন যখন মাটি কাটবে তখন সব মাটি ও পাথর একটি পাইপের মাধ্যমে আলাদা ট্রিটমেন্ট প্লান্টে চলে যাবে। পেছন দিক দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কংক্রিটের একেকটি সেগমেন্ট ঢুকে চারিদিকে গোলাকারের শক্ত দেয়াল তৈরি করবে। ফলে মেশিন যতই এগোবে, ততই আকার পাবে টানেল।

টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিংজিয়ান শহরে টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্টে সেগমেন্ট নির্মাণের কাজ চলছে। গত বছর পর্যন্ত চার হাজার ২৫০টি সেগমেন্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৬৮টি সেগমেন্ট চট্টগ্রামে প্রকল্প এলাকায় এসে পৌঁছেছে। পুরো টানেল তৈরিতে এমন ২০ হাজারের বেশি সেগমেন্ট প্রয়োজন হবে।

প্রতি আটটি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি হবে। প্রতিদিন এভাবে চার-পাঁচ মিটার করে টানেল তৈরির কাজ এগোবে। প্রথম যাত্রায় পতেঙ্গা থেকে শুরু করে টিবিএম মেশিনটি আনোয়ারা অংশে বের হবে, যা দুই লেনের একটি টিউব সড়ক হবে। সেটি শেষ হলে টিবিএম আনোয়ারা প্রান্ত থেকে নদীর তলদেশে ঢুকে আরেকটি দুই লেনের সড়ক খোদাই করে পতেঙ্গা অংশে বের হবে। এভাবে দুটি টিউবে চার লেনের সড়ক পথ হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে।

২০০৮ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে প্রস্তাবটি প্রকল্প আকারে উত্থাপন করা হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট চূড়ান্ত হওয়ার পর স্থান নির্বাচন নিয়ে কেটে যায় আরো দুই বছর। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এসে কর্ণফুলীর মোহনায় টানেল নির্মাণে একমত হন নগরবিদ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শক ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।

টানেল নির্মাণে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিসি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পসহ মোট ছয়টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন।

২০২২ সাল নাগাদ টানেল নির্মাণ শেষে হলে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে শুরু হবে গাড়ি চলাচল। বিশ্ব দেখবে সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কর্ণফুলী টানেল,কর্ণফুলী,টিবিএম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close