শাহ্জাহান সাজু

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি ফাঁক শনাক্তের উদ্যোগ

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিমাণ ৯৯ হাজার কোটি টাকা

বেড়েই চলছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। ব্যাংকিং খাতে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম খেলাপি ঋণ। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে একই সময়ে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। ফলে দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এই অবস্থায় খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনের ফাঁক-ফোকরগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের কেন্দ্রীয় এই ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার কী করণীয় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলাদা দুটি কমিটি কাজ করছে। এর বাইরে আইন কমিশন, আইন মন্ত্রণালয়, বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত করা হচ্ছে।

সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারি আইন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যংক। নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরপরই আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ব্যাংক মালিকরা বৈঠক করেন এমডিদের সঙ্গে। এ সময় মালিকদের পক্ষ থেকেও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিদের।

এ বিষয়ে এরই মধ্যে নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, খেলাপি ঋণ আমাদের থামাতে হবে। জাতিকে খেলাপি ঋণ থেকে মুক্ত করতে হবে। কারণ ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা, কৃষকের টাকা, এই টাকাকে খেলাপিতে পরিণত করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে সারা দেশের অর্থঋণ আদালতে ব্যাংকগুলোর করা মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার ২৯৬টি। এসব মামলার বিপরীতে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা পাওয়া রয়েছে ব্যাংকগুলোর। তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকনাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মামলার সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার ৬৩টি। এতে পাওনা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪৯ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে ৭ হাজার ৩১৪টি। এর বিপরীতে টাকা আটকে আছে ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা।

অর্থঋণ আদালতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ২৮ হাজার ৫৮২টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় ৫২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা পাওনা। এছাড়া ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থঋণ আদালতে ২ হাজার ৩৩৭টি মামলা রয়েছে। এর বিপরীতে প্রায় ৫ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা পাওনা। মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় এ বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে আছে। অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণ বিষয়ে হাইকোর্টে ৫ হাজার ৩৭৬টি রিট মামলা রয়েছে। এর বিপরীতে ৫২ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এসব রিটের মাধ্যমে আবেদনকারীরা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে অর্থ্যাৎ ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৬ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের শুরুতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১০ সালে সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, ২০১১ সালে যা নেমে আসে ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকায়। ২০১২ সালে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা হয়। ২০১৩ সালে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা কমে ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায় নেমে আসে খেলাপি ঋণ। ২০১৪ সালে আবার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকায়। ২০১৫ সালে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে (সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।

সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৫৯টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংক ৪১টি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ৯টি এবং অবশিষ্ট বাকি ৯টি হলো বিদেশি ব্যাংক। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ৪৯ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রায় ৪৯ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই খেলাপি ঋণের কারণেই নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আইন কমিশন, আইন মন্ত্রণালয়, বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়সহ সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
খেলাপি ঋণ,ব্যাংক খাত,আইনি ফাঁক,বাংলাদেশ ব্যাংক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close