শাহ্জাহান সাজু

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯

কালোটাকা বিনিয়োগ রোধে সঞ্চয়পত্রের ডাটাবেজ হচ্ছে

কোন শ্রেণির ব্যক্তিরা সঞ্চয়পত্র কিনছেন বা কারা সঞ্চয়পত্র বেশি কিনছেন তা জানতে এবার তৈরি হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের ডাটাবেজ। ডাটাবেজ তৈরি হয়ে গেলে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য আয়কর সনদ (ই-টিআইএন) ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বাধ্যতামূলক করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্র খাতে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে এবং ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধে এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে শিগগিরই নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে চুক্তি করবে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার একটানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে দুর্নীতি দমনে উদ্যোগ নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্র খাতকেও দুর্নীতিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কারণ ধারণা করা হয় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয় করা অর্থের একটা বড় অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়। তাছাড়া সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পরিমাণে বিক্রি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। এতে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত ব্যাংকের আমানতের সুদের চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা মিলছে সঞ্চয়পত্রে। এ কারণেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সঞ্চয়পত্র অধিদফতর সূত্র জানায়, সঞ্চয়পত্র খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালোটাকা) বিনিয়োগ বন্ধে সঞ্চয়পত্রে এনআইডি ও টিআইএন যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই নির্বাচন কমিশন ও এনবিআরের সঙ্গে এ বিষয়ে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর চুক্তি করবে। জানা যায়, সম্প্রতি সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক বৈঠকে সঞ্চয়পত্র খাতে টিআইএন সনদ ও এনআইডি বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে

অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময়সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিল এবং সম্পদ কমিটির ওই সভায় সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, সঞ্চয়পত্রে যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে কেউ অবৈধভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারবে না।

বৈঠকে আরো বলা হয়, সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারকে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে তা এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈঠকে তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সব কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনার।

জানা যায়, কোন শ্রেণির ব্যক্তিরা সঞ্চয়পত্র কিনছেন ওই বিষয়ে এখন পর্যন্ত সঞ্চয় অধিদফতর কোনো গবেষণা করেনি। ফলে সমাজের কোন শ্রেণির ব্যক্তিরা সঞ্চয়পত্র বেশি কিনছেন তার হিসাব নেই। তবে ১৮ বছরের বেশি বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো সুস্থ নাগরিক সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের একটা বড় অংশ সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে। তাছাড়া সঞ্চয়পত্র কিনছেন ধনীরাই। সাধারণ বা স্বল্প আয়ের মানুষ ও পেনশনভোগীদের সুবিধার কথা বলা হলেও বাস্তবে ৯০ শতাংশ সঞ্চয়পত্র কিনছেন বড় পদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। ৮৫ শতাংশ সঞ্চয়পত্র মাত্র ১২ শতাংশ লোকের কাছে বিক্রি হচ্ছে। মাত্র ১৫ শতাংশ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে বাকি ৮৮ শতাংশ লোকের কাছে।

জানা যায়, ক্রমেই বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের (জুলাই-নভেম্বর) প্রথম পাঁচ মাসে ২১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৫ম মাস নভেম্বরে নিট ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার ঋণ এসেছে সঞ্চয়পত্র থেকে। আলোচ্য সময়ে (জুলাই-নভেম্বর) আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয় ৯ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। অর্থাৎ জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর মুনাফা দেয় সরকার। মেয়াদপূর্তির পরে বিনিয়োগকৃত অর্থও ফেরত দেওয়া হয়। প্রতি মাসে বিক্রি হওয়া সঞ্চয় স্কিমগুলোর প্রাপ্ত বিনিয়োগের হিসাব থেকে আগে বিক্রি হওয়া স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে নিট ঋণ হিসাব করা হয়। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্রগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বর্তমানে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।

এদিকে গেল ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১২ মাসে মোট ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা বাবদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। মুনাফা পরিশোধ হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কালোটাকা,বিনিয়োগ রোধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close