নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

জাহাজশিল্প : সৃষ্টি হচ্ছে হাজারো কর্মসংস্থান

নারায়গঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরঘেঁষে যে পিচঢালা সড়কটি গাজীপুরের কালীগঞ্জে গিয়ে মিশেছে, সেই রাস্তা ধরে মাত্র এক কিলোমিটার এগোলেই নদীর চরে জাহাজ তৈরির অসংখ্য কারখানার দেখা পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যেই শীতলক্ষ্যা পারের এলাকাটি এলাকাবাসীর কাছে জাহাজের চর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

আর এ জাহাজের চরটিই হলো রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন। কায়েতপাড়া হাজার মানুষের পদচারণে এখন কর্মমুখর জনপদ। কায়েতপাড়ার পূর্বগ্রাম, বড়াল, মাঝিনা, ভাওয়ালীয়াপাড়া, ডাক্তারখালী, হড়িনা ও ইছাখালীর চরে রয়েছে অর্ধশতাধিক জাহাজ তৈরির কারখানা। এছাড়া উপজেলার দাউদপুরের বেলদী এবং মুড়াপাড়া ইউনিয়নের গঙ্গানগর, মাঠেরঘাট ও দড়িকান্দির চরে রয়েছে আরো ৮ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠান।

মাসটাং ডকইয়ার্ড, খান ডকইয়ার্ড, ফাহিম ডকইয়ার্ড, শামস ডকইয়ার্ড, ভাই ভাই ডকইয়ার্ড, তালহা ডকইয়ার্ড, আমির ডকইয়ার্ড, মালেক ডকইয়ার্ড, ফটিক ডকইয়ার্ড, মনির ডকইয়ার্ড, মাসটাং ইঞ্জিনিয়ারিং কায়েতপাড়ার জাহাজ কারখানাগুলো অন্যতম। আড়াইশ ফিট থেকে শুরু করে শত ফিটের কোস্টার বা মালবাহী জাহাজ, সরোঙ্গা, ফেরি, জেটি, পন্টন, বালুবাহী ট্রলার, বলগেট আর ডেজার তৈরি হয় শীতলক্ষ্যার এই চরে। দিনভর টানা খটখাট আর টুংটাং শব্দ শোনা যায় এলাকাজুড়ে।

জাহাজ তৈরির পদ্ধতি : জাহাজ তৈরিতে মূলত ব্যবহার হয় লোহার প্লেনশিট আর অ্যাঙ্গেল। অতিরিক্ত উপাদান বলতে টি -গার্ডার, বিট-গার্ডার, রং, ইট, বালি, সিমেন্ট, গ্যাস সিলিন্ডার, অক্সিজেন, ওয়েল্ডিং বড় আর লেদ মেশিনের কিছু খুচরা কাজ। মেশিন আনতে হয় বিদেশ থেকে।একটি বড় মাপের কোস্টার জাহাজ তৈরির জন্য প্রমে রাজমিস্ত্রি বেইস লাইন তৈরি করেন। পরে ঠিকাদারের নির্দেশনক্রমে ফিটাররা জাহাজের মলিন তৈরি করেন।

ওয়েল্ডার ঝালাইয়ের মাধ্যমে জাহাজটির খাঁচা তৈরি করা হয়। একটি বডি দাঁড় করানোর পর চলে মেশিন স্থাপন আর রঙের কাজ। জাহাজে তিন-চারটি খুপরি বা হোস থাকে। যেখানে ৩০০-৪০০ টন পর্যন্ত মাল বহন করা যায়। প্লেনশিট আসে চট্টগ্রাম থেকে। বিদেশি কাটা জাহাজের ৮ থেকে ১২ মিলির শিট ব্যবহার করা হয় জাহাজ তৈরিতে। ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে শিট কিনতে হয়। আর লোহার অ্যাঙ্গেল ১২০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যায় স্থানীয় বাজারে। ৮-৯ লাখ টাকায় জাহাজের মেশিন আমদানি করা হয় চীন থেকে।

আর অন্য মালামাল আসে ঢাকার বংশাল অথবা চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী থেকে। সর্বসাকুল্যে একটি বড় জাহাজ তৈরিতে ১১-১২ কোটি টাকা খরচ হয়। এরপর মালিকরা সুবিধামতো লাভ করে তা বিক্রি করেন। একটি জাহাজ ২০ থেকে ২৫ জন কারিগর মিলে তৈরি করতে ১২ থেকে ১৫ মাস লাগে।

সম্পৃক্ততা যাদের : শোনা যায়, জাহাজ তৈরি হলো দোহারবাসীর প্রাচীন ব্যবসা। হালে বাংলাদেশে যারা জাহাজ তৈরি করেন বা জাহাজের ব্যবসা করেন, তাদের অধিকাংশের বাড়ি ঢাকার দোহারে। অনেকে মজা করে বলেন, বাড়ি আমার দোহার, কাজ করি লোহার। এ ছাড়া জাহাজ তৈরির কারিগরদের অনেকের বাড়ি বিক্রমপুর, পিরোজপুর, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ আর নবাবগঞ্জে। রং এবং রাজমিস্ত্রির কাজ করেন স্থানীয়রা। জাহাজ তৈরির জন্য যিনি জমি দেন এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন, তাকে বলা হয় কারখানা মালিক। যারা জাহাজটি ফিটিংস করেন, তাদের বলা হয় ফিটার। জাহাজে ঝালাইয়ের কাজ করেন ওয়েল্ডার আর পুরো ব্যাপারটা যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি হলেন ঠিকাদার।

জাহাজ তৈরির সব উপকরণ কিনে দেন জাহাজের মালিক। জমির মালিক একটি জাহাজ ফেলার জন্য জমির ভাড়া নেন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। একজন ঠিকাদারের মাসিক বেতন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। একজন রাজমিস্ত্রি দৈনিক হাজিরা পান ৫০০ টাকা, তার সহযোগী ৪০০ টাকা। ফিটারের দৈনিক বেতন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। ওয়েল্ডার পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। রং মিস্ত্রির হাজিরা ৫০০ টাকা, তাদের সহকারীদের বেতন ৩০০ টাকা। আর সব হেলপারের দৈনিক হাজিরা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে।

সব খরচ শেষে একটি জাহাজ পানিতে নামানোর পর জাহাজের মালিক আলোচনার ভিত্তিতে তা বিক্রি করেন। বছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার মতো তাদের আয় হয় বলে জানা যায়। এলাকায় জাহাজ নির্মাণশিল্পটি গড়ে উঠায় এখানে বাড়ি ভাড়া, গর্দার ব্যবসা, লেদ মেশিন, খুচরা যন্ত্রাংশ আর পান-সিগারেটের দোকান দিয়ে এলাকার মানুষ বাড়তি উপার্জন করছেন।

শ্রমিকদের সুখ-দুঃখের কথা : ফিটার লোকমান, জাফর, জাহিদ, আলম ওয়েল্ডার কবির, মালেক আরো অনেকে জানান, হিসাব কষে খেয়ে দেয়ে সামান্য টাকাই জমা রাখতে পারেন। বেতন অনেক কম, তার পরও করার কিছু নেই। এই কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ তারা শিখেননি।

জাহাজের মালিক ওসমান ঢালী, লতিফ, আনোয়ার হোসেন, কামাল, মাহফুজ, আবদুল মজিদসহ আরো অনেকে বলেন, রোজ হাজিরা মালামাল কেনা, বিদ্যুৎ বিল আর জমির ভাড়ার ভেতর লুকিয়ে থাকে জাহাজের লাভ-লোকসানের ব্যাপার। এ কারণে হিসাব কষে সবাইকে টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া মালামালের দাম যে হারে বাড়ছে, জাহাজের দাম কিন্তু আগের তুলনায় বাড়েনি।

তবে বেশ খুশি মাসটাং ডকইয়ার্ডের ম্যানেজার ফারুক আহমেদ, বাড়িওয়ালা নুরুল হুদা, সাঈদ আহমেদ, হাবিব, সুমন, খোকন, আলী আকবরসহ আরো অনেকে। তাদের মতে, এলাকায় জাহাজশিল্প গড়ে উঠায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

শীতলক্ষ্যা পাড়ের জাহাজ মালিক সমিতির সভাপতি এবং মাসটাং ইঞ্জিনিয়ারিং ও মাস্টাং ডকইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী সাজ্জাদ হোসেন তুহিন বলেন, কায়েতপাড়ার শিল্পটি ঝুঁকির মুখে। মালামালের বাড়তি দাম এবং কাঁচামাল আমদানির ভালো সুবিধা না থাকায় প্রায় লোকসানের মুখ দেখতে হয় মালিকপক্ষের।

সাধারণ সম্পাদক মহব্বত হোসেন খান নয়ন জানান, জাহাজ মালিকদের সঙ্গে বাতিল মালামাল কেনা নিয়ে ফ্যাসাদে জড়ান গর্দা ব্যবসায়ীরা। আর এলাকার আর্থিক উন্নতির কারণে অনেকে মাদক সেবন ও ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। নেশার টাকা জোগাতে জাহাজের যন্ত্রাংশ ও বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনাও ঘটছে।

এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর (বীরপ্রতীক) জানান, অবহেলিত কায়েতপাড়ায় জাহাজশিল্প গড়ে উঠায় ধীরে ধীরে স্বনির্ভর হয়ে উঠছে। শিল্পটি রক্ষা করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আবেদন জানান।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাহাজশিল্প,শীতলক্ষ্যা নদী,জাহাজের চর,রূপগঞ্জ উপজেলা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close