নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ অক্টোবর, ২০১৮

খেলাপি ঋণে উদ্বেগ, রেমিট্যান্স বেড়েছে

গেল অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ‘সুখবর’ নিয়ে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরটাও আশার কথাই বলছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রবাসী আয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের খরা কাটিয়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ করে বাংলাদেশ। নতুন অর্থবছরেও সেই ধারা বজায় থাকাকে সুখবর বলছেন অর্থনীতিবিদরা। আর চলতি বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে এই প্রবৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া, দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রবাসী আয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ৩৮৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি। আর সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে ১১২ কোটি ৭৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অংক গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই রেমিট্যান্স ১৩ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি, রফতানি ও রেমিট্যান্সের ধারা অব্যাহত থাকলে এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়লে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। আগামীতে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বেশ কিছু সংস্কার আনতে হবে।

প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্বব্যাংক বলছে, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাবে। এতে করে বাজেটে চাপ বাড়বে। এজন্য আর্থিক খাতে সংস্কার আনতে হবে। খেলাপি ঋণের দিকে নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশে। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট ঋণের ৪৮ শতাংশই খেলাপি ঋণ। এছাড়া, ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের বড় অংশই খেলাপি ঋণ। ব্যাংক খাতের এই বিশাল ঋণ আদায়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রফতানি খাত ও রেমিট্যান্স প্রবাহে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ালেও ব্যাংকিং খাতের বোঝা অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এতে বলা হয়, যাদের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে সরকার ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তারা পাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ খাতে জোর দিতে হবে। এক হিসাবে বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০১১-২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এ সময়ের মধ্যে দুধ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ২০৩০ সালের বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলায় এখন থেকেই উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে জ্বালানি ব্যবহারের অপচয় রোধ করতে হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশে গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় ৬/৭ গুণ কম। গ্যাস ব্যবহারে অপচয়রোধ করা গেলে ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে জানানো হয়। বিশ্বব্যাংক জানায়, বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়ন করছে। উন্নয়ন ধরে রাখতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। রফতানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি যেন কমে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিশ্বের ১০টি উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এজন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ক্ষেত্রে যদি সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে, বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে জোগান সমন্বয় করা গেলে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, জিডিপির গ্রোথ সরকারিীহিসাবে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এটা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে, এখানে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। গত কয়েক বছরে রফতানি আয় হতাশাজনক। জিডিপির তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি কম হলে কিভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়বে?

তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স কমছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। তিনি বলেন, ব্যাংকের নয়-ছয় পলিসি নির্ধারণ কোনো কাজে আসেনি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে।

আহসান এইচ মনসুর, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের গুণগত মান ও খরচ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এসব মেগা প্রকল্প থেকে কী ধরনের অর্থনৈতিক সুফল আসবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো হিসাব এখনো করা হয়নি। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর যেভাবে ব্যয় বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কিনা সেগুলো ভেবে দেখতে হবে। কেননা বাংলাদেশে এখনো ১৯ মিলিয়ন লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সাড়ে ৫ মিলিয়ন শিশু এবং ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন নারী অপুষ্টিতে ভুগছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সুফল কার কাছে যাচ্ছে, সেটা বের করতে হবে।

প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান, প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরসহ বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রেমিট্যান্স,খেলাপি ঋণ,উদ্বেগ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close