নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পোড়া ইটের ব্যবহারে দেশ খাদ্য ও পরিবেশ সংকটে পড়বে

‘পোড়া ইটের বিকল্প কংক্রিটের ব্লক’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, পোড়া ইট তৈরি করতে দেশের কৃষি জমির টপ সয়েল (মাটির উপর ভাগ) কেটে ফেলা হচ্ছে। এতেকরে জমিগুলো উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। একইসাথে কাঠ বা কয়লা পুড়িয়ে ইট তৈরির কারণে পরিবেশও মারাত্মকভাবে দূষিত করছে।পোড়া ইটের ব্যবহার বন্ধ না করা হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ ও খাদ্য সংকট তৈরি করবে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে পোড়া ইটের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।

বক্তারা আরও বলেন, পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশসহ উন্নত দেশগুলো বহু আগ থেকে পোড়া ইট তৈরি নিষিদ্ধ করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে টপ সয়েলের ব্যবহার বন্ধের মাধ্যমে পোড়া ইট তৈরি নিষিদ্ধ করেছে। কেননা, টপ সয়েল ছাড়া পোড়া ইট তৈরি করা যায় না। এ কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবৈধভাবে পোড়া ইট পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অবিলম্বে পোড়া ইট ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প কংক্রিট ব্লক বা অন্য কোন উদ্ভাবিত উপকরণ ব্যবহারের উৎসাহিত করতে হবে।

আজ বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম-বাংলাদেশের (সিডিজেএফবি) আয়োজনে ‘পোড়া ইটের বিকল্প কংক্রিট ব্লক’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সংগঠনের সভাপতি অমিতোষ পালের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মতিন আব্দুল্লাহর সঞ্চালনায় সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন-গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বাংলাদেশ রেডিমিক্স কংক্রিট এসোসিয়েশনের সভাপতি প্রকৌশলী মোঃ আবদুল আউয়াল।

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ ও কৃষি জমি রক্ষা করতে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ইটভাটা তুলে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, আমিও টপ সয়েল ব্যবহারের বিপক্ষে। জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করে যেভাবে ইট তৈরি করা হচ্ছে তাতে কৃষি জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। আর ইট ভাটার ধোয়ায় বায়ূ মারাÍকভাবে দূষিত করছে। পোড়া ইটের ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে কংক্রিটের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে ইতিমধ্যে সরকার কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার শুরু করেছে। ভাষানচরে রোহিঙ্গা পূর্নবাসনের জন্য যেসব আবাসন করা হচ্ছে, সেসব কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া নোয়াখালীতে গণপূর্ত অধিদফতরের ১০টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কংক্রিট ব্লক দিয়ে।

মন্ত্রী আরও বলেন, ইটের খোয়ায় নির্মিত সড়কের স্থায়ীত্ব অনেক কম। কোথাও ইটের খোয়া দিয়ে সড়ক করলে দেখা যায় ৬ মাসের মধ্যে সেগুলো গলে যাচ্ছে অথবা গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আর কংক্রিটের ব্লক দিয়ে সড়ক করলে তার স্থায়ীত্ব দীর্ঘ হয়। এ কারণে সড়কের টেকসইয়ের জন্য ইটের খোয়ার পরিবর্তে পাথরের খোয়া ব্যবহারের চিন্তা করতে হবে। তবে দেশে পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিটের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পাথর আমদানিতে শুল্ক সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। অন্যথায় মানুষ পাথর ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে।

কংক্রিট ব্লক বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার আবু সাদেক বলেন, দেশে নিবন্ধিত ইটভাটার সংখ্যা ৭ হাজার ৯০০টি। আর নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে দেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা ৪৫ হাজার। নানা কারণে প্রতিবছর দেশে শতকরা ১ ভাগ কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। কমছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্যমতে, ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ জমি ইটভাটার কারণে কমছে। আর ৮০ ভাগ জমি কমছে অপরিকল্পিত আবাসনের কারণে।

তিনি আরও বলেন, দেশে ২০৪০ সালে জনসংখ্যা হবে ২৪ কোটি ৫০ লাখ। এরপর জনসংখ্যা বাড়বে না বরং কমতে থাকবে। তারপরেও ওই জনসংখ্যার আবাসনের প্রয়োজনে ভরাট হবে আরো অনেক কৃষি জমি। সে সময়ের বিদ্যমান জমিগুলো দিয়ে ৫ কোটি মানুষের খাদ্যে’র চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এখনই যদি পোড়া ইট বন্ধ না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে মারাÍকভাবে পরিবেশ ও খাদ্য সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। অন্যদিকে পোড়া ইট তৈরিতে যে, জ্বালানি খরচ হয়, ওই জ্বালানি দিয়ে অন্তত বছরে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। আর পোড়া ইটের তুলনায় কংক্রিট ব্লকের নির্মাণ খরচও ৩০-৪০ ভাগ কম হয়। এসব আমরা গবেষণা করে দেখেছি।

প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, দেশে ইটভাটার কারণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য ঝুকি বাড়ার পাশাপাশি পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। ইটভাটা বন্ধে কংক্রিট ব্লক ব্যবহারে উপকারিতা জনগনের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাহলে মানুষ সচেতন হবে এবং কংক্রিট ব্লক ব্যবহারে উৎসাহিত হবে। তবে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের পোড়া ইটের সঙ্গে কংক্রিট ব্লকের তুলনামূলক চিত্র জনগনের সামনে তুলে ধরতে হবে। লাভ ক্ষতির গবেষণাধর্মী চিত্র তুলে ধরলে মানুষ কংক্রিট ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সে’র (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে ইটভাটা থেকে আমাদেরকে সরে আসতে হবে। এ ইটভাটার ফলে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইটভাটার বিকল্প ব্যবহার শুরু করতে হবে। ২০২০ সালের মধ্যে পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান এই পরিকল্পনাবিদ।

বাংলাদেশ রেডমিক্স কংক্রিট এসোসিয়েশনের প্রকৌশলী প্রকৌশলী মোঃ আবদুল আউয়াল মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, এখন বছরে দেশে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি (১৭ বিলিয়ন) পিস ইট তৈরি হচ্ছে। প্রতিমিলিয়ন ইট তৈরিতে পোড়াতে হয় ২৪০ মিলিয়ন টন কয়লা। এসব ইট পোড়াতে কয়লার পাশাপাশি গ্রামঞ্চলে বনভূমি ধ্বংস করেও পোড়ানো হচ্ছে কাঠ ও বাঁশ। ইটভাটাগুলো থেকে বছরব কম হলেও ৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে, যা দেশের মোট কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের প্রায় ২৩ শতাংশ।

মূল প্রবন্ধে সরকারের কাছে পাঁচ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের আহবান জানানো হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-১. অবিলম্বে সমস্ত সরকারি ও আধা সরকারি ভবনে পোড়া ইটের ব্যবহার বন্ধ করা ২. ২০২০ সালের পর ঢাকাসহ সকল বিভাগীয় শহরে ভবন নির্মাণের ইট ব্যবহার বন্ধ করা ৩. ২০২২ সালের পর দেশের সকল জেলা শহরে ভবন নির্মাণে পোড়া ইটের ব্যবহার বন্ধ করা ৪. ২০২৫ সালের পর সকল উপজেলা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ভবন নির্মাণে পোড়া ইটের ব্যবহার বন্ধ করা এবং ৫. পোড়া ইটের বিকল্প যে কোন প্রকার ব্লক তৈরির ফ্যাক্টরীকে নূন্যতম দশবছরের জন্য সকল প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাটের আওতামুক্ত ঘোষণা করা।

অন্যান্যের মধ্যে সেমিনারের আলোচনায় অংশ নেন-বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সে’র (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক, কংক্রিট ব্লক বিশেষজ্ঞ মোঃ আবু সাদেক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ হাসিবুল কবির, সাংস্কৃতিক কর্মি মনোরঞ্জন ঘোষাল, পরিবেশ কর্মি তুষার রেহমান, সিনিয়র সাংবাদিক তৌফিক আলী প্রমুখ। এ সেমিনারের সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন, দি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড ও আবাসন নিউজ ২৪ ডট কম।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সেমিনার,পোড়া ইট,কংক্রিটের ব্লক,পরিবেশ সংকট,পোড়া ইটের ব্যবহার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close