শাহ্জাহান সাজু
বিনিয়োগ বাড়াতে আসছে কর-ছাড়
আসন্ন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটই চলতি মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বাজেট। বাজেট ঘোষণার ঠিক ছয় মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই ভোটার সন্তুষ্টিকে মাথায় রেখে চলতি মেয়াদের শেষ বাজেটে বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। শ্লথগতির বেসরকারি বিনিয়োগকে চাঙা করতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে করপোরেট কর হারে। পরিহার করা হবে সাবসিডিয়ারি কোম্পানির দ্বৈত কর। এ ছাড়া কোনো খাতেই নতুন করারোপ করা হচ্ছে না। বাড়তে পারে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমাও। সেবা ও পণ্যের ভ্যাট যৌক্তিক করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, আসন্ন বাজেটে রাজস্ব আয়ের বড় লক্ষ্য অর্জনে ভ্যাটে অনলাইন ব্যবস্থা কার্যকরসহ বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হবে। পাশাপাশি শুল্ক খাতে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখাসহ অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক বাড়ানো হবে। তবে শিল্পের কাঁচামালের শুল্ক অপরিবর্তিত থাকবে।
জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের সম্ভাব্য আকার হবে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। এই বিশাল লক্ষ্য অর্জনে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটকে গুরুত্ব দিচ্ছে এনবিআর। মূলত ভ্যাট সিস্টেমকে অনলাইন নির্ভর করে তোলার প্রত্যাশা নিয়েই মূসকে এই বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এনবিআর এবার ভ্যাট খাত থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, আয়কর খাতে ৯৭ হাজার কোটি টাকা এবং শুল্ক খাতে ৮৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে রাজস্ব আয়ের এই বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও নির্বাচনী বছর হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন করারোপ করা হবে না। উল্টো আয়করে করপোরেট কর হার হ্রাস, সাবসিডিয়ারি কোম্পানির দ্বৈত করারোপের মতো বিতর্কিত কর ব্যবস্থা বাতিল করা হচ্ছে। কারণ এসব কর ব্যবস্থাকে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগের অন্তরায় হিসেবে বলে আসছেন।
ইতোমধ্যেই করপোরেট কর হার হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আসন্ন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটে যেসব খাতে বর্তমানে ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর বহাল আছে, সেসব খাতে এ হার সাড়ে ৩৭ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তবে মোবাইল ফোন এবং তামাকজাত পণ্য উৎপাদন খাতে কর হার ৪৫ শতাংশই বহাল থাকছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২৫ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর হার ৩৫ শতাংশ বলবৎ আছে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর হার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়।
সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন খাতে কর ছাড়ের বিপরীতে আয়করের বিশাল লক্ষ্য আদায়ের কর জাল বৃদ্ধি ও উৎস কর আদায় কার্যক্রমকে জোরদার করতে চাইছে এনবিআর। এজন্য উৎসে কর আদায়ের হারে পরিবর্তন আসতে পারে। নতুন বাজেটে এসব বিষয়ে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেবেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা ১০ম বাজেট সংসদে উপস্থাপন করবেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
সূত্র জানায়, মূসক থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে মূসক ব্যবস্থাকে অনলাইন নির্ভর করে গড়ে তুলতে পুরনো ভ্যাট আইনের বিধিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এজন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল পদ্ধতি চালু করা হবে। পাশাপাশি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেও রিটার্ন জমার বিধান থাকবে। স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ট্যারিফ ভ্যালু আরোপিত পণ্যের ভ্যালু যৌক্তিক করা হবে। এটি করা হলে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট আদায়ের সম্ভাবনা আছে। বর্তমানে শতাধিক পণ্যের ওপর ট্যারিফ ভ্যালু আরোপিত আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—আচার, চাটনি, টমেটো সস, গুঁড়া দুধ, হলুদ, মরিচ, ধনিয়াসহ সব গুঁড়া মসলা, ফলের জুস, এলপি গ্যাস, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন, বাল্ব ইত্যাদি। এ ছাড়া সংকুচিত ভিত্তি মূল্য পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। বর্তমানে ২২টি সেবা ও পণ্যের ওপর ৯ স্তরে দেড় থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর আছে। এসব সেবা ও পণ্যের ভ্যাট যৌক্তিক করা হবে।
ভ্যাটের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ২০১২ সালের ভ্যাট আইন অনুযায়ী, আমাদের কমিটমেন্ট ছিল ভ্যাটের স্তর একটি করা। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারিনি। তবে আমরা আগামী বাজেটে ভ্যাটের স্তর ৯ থেকে কমিয়ে ৫টিতে নামিয়ে আনব। মূল লক্ষ্য তিনস্তরে নামিয়ে আনা। ভ্যাটের সর্বোচ্চ হারটা ১৫ শতাংশই থাকবে। নিচেরগুলো পরিবর্তন করা হবে বলে।
সূত্র আরো জানায়, রাজধানীর বড় বড় বিপণিবিতানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালু করতে ইসিআর বিধিমালা সংশোধন করা হবে। পাশাপাশি ভ্যাট আদায়ের বড় খাত বিড়ি-সিগারেটের দিকেও নজর দেওয়া হবে। সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক হার বাড়ানো হবে। পাশাপাশি বিড়ির ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বাতিল করে সিগারেটের মতো সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হতে পারে। এ ছাড়া শুল্ক খাতে খুব পরিবর্তন আসবে না। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখা হবে। বিলাসজাত ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। যেসব শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালে বেশি শুল্ক আছে বিনিয়োগের স্বার্থে সেগুলো সমন্বয় করা হবে। পাশাপাশি আমদানি পর্যায়ে ট্যারিফ ভ্যালু ও ন্যূনতম মূল্য সংশোধনের মাধ্যমে আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধের প্রচেষ্টা চালানো হবে।
পিডিএসও/হেলাল