গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৭ এপ্রিল, ২০১৮

নামেই স্মার্ট টেকনোলজিস!

নিম্নমানের এনআইডি বিতরণ বন্ধ | প্রায় ৯ কোটি টাকা পানিতে যাওয়ার উপক্রম | অর্থ ছাড়ে ভেন্ডার সংস্থার দেনদরবার

শাস্ত্রে আছে, ‘ধারে কাটে না হয় ভারে কাটে।’ কিন্তু ‘স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি’ নামে একটি ভেন্ডার প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এর কোনোটাই খাটে না। তবুও এই প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি মুদ্রণের কাজ। প্রতিষ্ঠানটি নামে যতটা স্মার্ট কাজে ততটাই আন-স্মার্ট। আর এদের কাজ দেখে রীতিমতো ভড়কে গেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

এদের তৈরি করা কার্ড বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে এই কাজের জন্য বরাদ্দ প্রায় ৯ কোটি টাকা জলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সর্বনিম্ন দুই দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে ওভারটেক করে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন খোদ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, কাগজে মুদ্রিত লেমিনেটেড এনআইডি মুদ্রণে গোঁজামিল ও দায়সারা কাজ সম্পন্ন করে বিল বাগিয়ে নিতে চেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু কাজটি এত নিম্নমানের যে, তা দেখে কাজ দেওয়া সংস্থা ইসিও ভড়কে গিয়ে মাঠ পর্যায়ে পাঠানো মুদ্রিত এনআইডি বিতরণ কার্যক্রম থামিয়ে রেখেছে। এখন স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ কাজের টাকা ছাড়ে এনআইডি নিবন্ধন অনুবিভাগে ধরনা দিচ্ছে।

ভেন্ডার প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ কর্মকর্তাকে আইডিয়া ও এনআইডি কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বলতে শোনা গেছে, ‘ভাই, অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছি। প্রতিষ্ঠানটি যাতে বাঁচে সেজন্য আপনাদের সহযোগিতা চাইছি।’ এদিকে ইতোমধ্যে আইডিয়া কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে সমাধানে পৌঁছাতে না পারায় পুনরায় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সঙ্কট উত্তরণের উপায় খুঁজছে ইসি। এর আগে ফ্রান্সের ওবারথু কোম্পানি লিমিটেড স্মার্ট কার্ড মুদ্রণে ব্যর্থতার কারণে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে পড়ে। পরে সরকারের অর্থায়নে স্মার্ট কার্ড মুদ্রণ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১০ কোটি ৪১ লাখ ভোটার রয়েছে। লক্ষ্য ছিল, সব ভোটারের হাতে স্মার্ট কার্ড তুলে দেওয়া। প্রথমে আইডিয়া প্রকল্প-১ এর অধীনে ৯ কোটি ভোটারকে এবং আইডিয়া প্রকল্প-২ এর আওতায় অবশিষ্ট ভোটারকে স্মার্ট পরিচয়পত্র দেওয়ার চিন্তা ছিল ইসির। এ লক্ষ্যে ২০১২ সাল পরবর্তী সব নিবন্ধিত ভোটারকে, যার সংখ্যা ৯৩ লাখ— নরমাল জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু স্মার্ট কার্ড বিতরণে প্রথম ধাপের কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে পরিচয়পত্র না পাওয়া ৯৩ লাখ ভোটারকে নরমাল পরিচয়পত্র দিতে গত বছরের ৩১ অক্টোবর কমিশনের ১২তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়।

এ মোতাবেক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ কাজের জন্য দরপত্র জমার শেষ দিন ছিল গত বছরের ৮ নভেম্বর। কাজটি পেতে ক্রিয়েটিভ বাংলাদেশ, এম এন মোল্লিক অ্যান্ড কোম্পানি এবং স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেড দরপত্রে অংশ নেয়। এর মধ্যে ক্রিয়েটিভ বাংলাদেশ ছিল সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল, যার টাকার পরিমাণ ৫ কোটি ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৬১ টাকা, দ্বিতীয় এম এন মোল্লিক অ্যান্ড কোম্পানির ৭ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং স্মার্ট টেকনোলজিসের ৮ কোটি ৯৬ লাখ ২৮ হাজার ৪০০ টাকা।

তথ্য পর্যালোচনার তথ্য মতে, সর্বনিম্ন দরদাতা থেকে ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বেশি দেখানো প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিসকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই কাজটি দেওয়া হয়। কাজটি পেয়েই অফিসের বড় বাবু সেজে বসে প্রতিষ্ঠানটি। মনের মাধুরী মিশিয়ে কার্ড মুদ্রণ করতে থাকে তারা।

জানা যায়, ৯৩ লাখ কার্ডের মধ্যে ৭০ লাখ মুদ্রণ সম্পন্ন করে কর্তৃপক্ষকে তা বুঝিয়েও দেয়। এমনকি কমিশন সেগুলো দেশের ৭ জেলার সব উপজেলায় বিতরণের জন্য পাঠায়, যা কমিশনের ১৭তম সভার কার্যপত্রে উল্লেখ রয়েছে।

বিতরণ করতে গিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে অভিযোগ পেয়ে তড়িঘড়ি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আইডিয়া প্রকল্পে উপ-প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হাইকে আহ্বায়ক এবং আইডিয়া প্রকল্পের সংযুক্ত কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবদুল্লা নাসের, এনআইডির সহকারী পরিচালক এএসএম ইকবাল হাসান ও আইডিয়া প্রকল্পের জুনিয়র কমিউনিকেশন্স কনসালট্যান্ট হোসাইন মোহাম্মদ আশিকুর রহমানকে সদস্য করা হয়।

কমিটি ভেন্ডার কর্তৃক মুদ্রণ কার্য পর্যবেক্ষণ, মুদ্রিত কার্ডের মান যাচাই ও ভোটার এলাকাভিত্তিক প্যাকিংসহ কার্ড বুঝে নেওয়ার জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বাকি ২৩ লাখ কার্ড মুদ্রণ কয়েক দিন পর্যবেক্ষণ করে।

পর্যবেক্ষণে কমিটি আট ধরনের ত্রুটি খুঁজে পায়। এর মধ্যে কার্ড মুদ্রণে রিফিল কালি ব্যবহার, কার্ড সঠিকভাবে কাটিং না করায় অসংখ্য কার্ডে ভোটারের তথ্য কাটা পড়া, লেমিনেটিং করার সময় মেশিনে সঠিকভাবে হিট না দেওয়ায় মুদ্রিত কার্ডটি খুলে যাওয়া, লেমিনেশন না করেই সংরক্ষিত বাক্সে পেপার কার্ড রাখা, পোড়া কার্ডও বাক্সে রেখে তার বিনিময়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, একই পাউচে একাধিক কার্ড সংরক্ষণ করা, পাউচের ভেতরে বাঁকানো কার্ড ঢোকানো এবং এক জেলার বাক্সে অন্য জেলার কার্ড সংরক্ষণ করে স্মার্ট টেকনোলজিস।

এসব অনিয়মের বিষয়ে কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ভেন্ডার সম্পূর্ণ অযত্ন ও অবহেলায় কার্ড মুদ্রণ ও লেমিনেশন কাজ করেছে। কাজের গুণগতমানের দিক বিবেচনা না করে দায়সারাভাবে কাজ শেষ করার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। এ ধরনের নিম্নমানের কার্ড গ্রহণ করে যদি মাঠ পর্যায়ে বিতরণের জন্য পাঠানো হয়, তাহলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিড়ম্বনার শিকার হবেন। পাশাপাশি ভোটাররা এ ধরনের কার্ড গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। এই নিয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে, যা কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।

এ ছাড়া কমিটি মুদ্রিত বর্তমান কার্ড মাঠ পর্যায়ে প্রেরণ করা সমীচীন হবে না বলে তাদের মতামত দেয়। আইডিয়া প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে জনবল নিয়োগ করে প্রত্যেক ভোটার এলাকাভিত্তিক কার্ডগুলোর মান যাচাই-বাছাই করা সমীচীন বলে কমিটি তাদের মতামতে তুলে ধরে। তারা আরো বলে, নিয়োগ করা জনবলের পারিশ্রমিক ভেন্ডার পরিশোধ করবে। একই সঙ্গে মুদ্রিত কার্ডগুলো পুনরায় মুদ্রণ করে বিতরণের ব্যবস্থা করাই শ্রেয় বলে মতামত দিয়েছে কমিটি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, স্মার্ট টেকনোলজিসকে দিয়ে নরমাল জাতীয় পরিচয়পত্র মুদ্রণের যে কাজটি করানো হচ্ছিল, তাদের কাজ নিম্নমানের হওয়ার কারণে ইতোমধ্যে সেসব মুদ্রিত কার্ড বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। কাজে অনিয়ম তদন্তে প্রথম কমিটির প্রতিবেদন পেয়েছি। এখন দ্বিতীয় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। তবে আরো বিস্তারিত জানাতে পারবেন এনআইডির ডিজি ও আইডিয়া প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রি. জে. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।

স্মার্ট টেকনোলজিসের কাজের মান বিষয়ে জানতে কয়েক দফা সেলফোন এবং অফিসের টিঅ্যান্ডটি নম্বরে যোগাযোগ করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিবুলের সেলফোন নম্বরে ফোন দিলে সংযোগটি বন্ধ পাওয়া যায়।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এনআইডি,স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি,এনআইডি মুদ্রণ,নির্বাচন কমিশন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist