হামিদুর রহমান, মাধবপুর (হবিগঞ্জ) থেকে

  ২৪ মার্চ, ২০১৮

সম্ভাবনাময় হলেও গুরুত্ব পাচ্ছে না পাম-অয়েল শিল্প

বিশ্বে কম জমিতে সবচেয়ে বেশি ভোজ্যতেল উৎপাদন হয় পাম-অয়েল। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই ভোজ্যতেল উৎপাদনের যথেষ্ট উপযোগিতা রয়েছে। সিলেটের বনবিভাগের উদ্যোগে হবিগঞ্জের মাধবপুরের সাতছড়ি তেলমাছড়ার ২০০ একর জমিতে পাম-অয়েল চাষ হয়েছে। ফলনও আশাব্যঞ্জক। তারপরও অবহেলায় আর উদাসীনতায় গুরুত্ব পাচ্ছে না ওই পাম-অয়েল প্রকল্পটি। অথচ সবদিক থেকে এই প্রকল্প থেকে সম্ভাবনাময় শিল্প গড়ে উঠতে পারত। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য পাম চাষ রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

জানা গেছে, মাধবপুর উপজেলার রঘুনন্দন পার্বত্য এলাকায় সাতছড়ি, তেলমাছড়াতে ১৯৮২-৮৪ সালে বন বিভাগের মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করে ২০০ একর জমিতে ৪ হাজার পাম গাছের চারা রোপণ করা হয়; যা বাণিজ্যিকভাবে যেকোনো ভোজ্যতেলের ফসল থেকে প্রাপ্ত তেল হতে অনেক বেশি। বর্তমানে জীবিত গাছের সংখ্যা ৩৭০০ ।

এর মধ্যে প্রায় ৩০০০ গাছে ফল আসছে। বছরে প্রায় আট মাস ফল আসে। প্রতি গাছে ১৫-২০টি থোকা ধরে। প্রতি থোকায় ফল আসে আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ কেজি; যা বাণিজ্যিকভাবে যেকোনো ভোজ্যতেলের ফসল থেকে প্রাপ্ত তেল হতে অনেক বেশি। ওই ফল থেকে প্রাকৃতিকভাবেই নতুন চারা সৃষ্টি হয়। ফলে দিন দিন নতুন গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাম-অয়েল গাছগুলো দেখতে খেজুর গাছের মতো। দেখতেও সুন্দর। অথচ সাড়ে ৭ লাখ টাকা খরচের পাম-অয়েল প্রকল্প অবহেলায় অযন্তে পড়ে রয়েছে। এ নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯১৭ সালে মালয়েশিয়ায় স্যালাঙ্গর বার্জুন্টাইয়ে প্রথম পাম চাষ হয়। এরপর মালয়েশিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে পাম-অয়েল শিল্পের ভিত্তি গড়ে ওঠে।

বন বিভাগ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পাম-অয়েল গাছ পরিবেশ অনুকূল জাতীয় উদ্ভিদ। উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় পাম-অয়েল গাছ চাষ করলে পাহাড় ধস, মাটির ক্ষয়রোধ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস রোধ করে। কারণ পাম-অয়েলের শিকড় অনেক দীর্ঘ এবং অসংখ্য।

অন্যান্য উদ্ভিদ্যের চেয়ে বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বেশি অক্সিজেন ছাড়ে। পাম-অয়েল ফলকে প্রক্রিয়াজাত করে দুই ধরনের তেল পাওয়া যায়। ফলটির মাংসল অংশ থেকে পাম তেল আহরণ করা যায়। বীজ বা শাস থেকে পাওয়া যায় কার্নেল। প্রতিটি ফল থেকে ১ ভাগ তেল ১ ভাগ পাম কার্নেল পাওয়া যায়। একটু পানিতে পাকা পাম ফল সিদ্ধ করে হাত দিয়ে চাপ দিলে রস বের হয়, সেই রসে পানি মিশ্রিত থাকে। এ জন্য পানি মিশ্রিত তেল পাত্রে জ্বাল দিলে পানি বাষ্প হয়ে চলে যায়। তারপর বোতল জাত করে রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। এই তেল স্বাদযুক্ত এবং গন্ধহীন।

এছাড়া এতে ভিটামিন ই-এর পরিমাণ অধিক। পাম-অয়েল খাদ্য ছাড়াও কসমেটিক, সাবান, মিল্ক পাউডার ইত্যাদিতে উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। হাতে তৈরি তেল দিয়ে ডিজেল ইঞ্জিন চালানো সম্ভব। সাতছড়ি বন্যপ্রাণী রেঞ্জ অফিসার মাহমুদ হোসেন জানান, বর্তমানে পাম-অয়েল ফল বন্য প্রাণীর একটি উৎকৃষ্ট খাবার। বিশেষ করে বানর জাতীয় প্রাণী এবং বন্য শুকরের। পাম-অয়েল গাছগুলো ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে খুব প্রিয়।

জানা গেছে, কম জমিতে অধিক উৎপাদনে পাম-অয়েলের তুলনা নেই। বিশ্বে মোট ২৫ কোটি ৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে ভোজ্য তেল চাষ হয়। এরমধ্যে সয়াবিন তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ৪০ শতাংশ জমি, কটনসীড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১৪ শতাংশ জমি, সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ১০ শতাংশ জমি, সরিষা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১৩ শতাংশ জমি এবং পাম তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় মাত্র ৫.৫ শতাংশ জমি। আরো আশ্চর্যজনক তথ্য হলো, ১ টন সেয়াবিন তেল উৎপাদনে যেখানে ২.২২ হেক্টর জমির প্রয়োজন, সেখানে পাম তেল উৎপাদনে প্রয়োজন মাত্র ০.২৬ হেক্টর জমি। এছাড়া ১ টন সরিষার তেল উৎপাদনে প্রয়োজন ১.৫২ হেক্টর এবং সুর্যমুখী তেল উৎপাদনে প্রয়োজন ২ হেক্টর জমি।

বিশ্বে প্রতি বছর ভোজ্য তেলের জোগান আসে ১৮ কোটি ৬৪ লাখ টন। এরমধ্যে ৩২ শতাংশ পাম তেল, ১৩ শতাংশ সয়াবিন তেল, ৮ শতাংশ সূর্যমুখী তেল, ৩ শতাংশ কটনসীড তেল এবং ২.২ শতাংশ বাদাম তেল। এছাড়া অন্যান্য তেলের জোগান আসে ১৯ শতাংশ। এক্ষেত্রেও পাম তেল এগিয়ে। বিশ্বেব মোট উৎপাদিত ভেজিটেবল তেলের মধ্যে পাম তেল হচ্ছে ৫৩.৬৭ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৪১.৬৬ শতাংশ, সরিষার তেল ২৮.৪৮ শতাংশ, সূর্যমুখী তেল ১৪.৮০ শতাংশ এবং পাম কার্নেল ৫.৯২ শতাংশ। এছাড়া বাদাম তেল ৪ শতাংশ, কটনসীড তেল ৫ শতাংশ, অলিভ তেল ৩.৩৬ শতাংশ এবং নারকেল তেলের অংশ হচ্ছে ৩.২৪ শতাংশ।

বিশ্বে মোট তেল বাণিজ্যের ৩২ শতাশই পাম তেলের দখলে, যার ৮৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। অন্যদিকে, বিশ্বে প্রতি বছর ১৮ কোটি ৩৬ লাখ টন ভোজ্য তেল ব্যবহৃত হয়। এরমধ্যে ৫৬ শতাংশই পাম তেল। আবার বিশ্বে মোট উৎপাদিত পাম তেলের মধ্যে ৪১ শতাংশ মালয়েশিয়া এবং ৪৬ শতাংশ ইন্দোনেশিয়া উৎপাদন করে। উল্লেখ্য ২০১৬ সনে মালেশিয়া প্রায় ১ কোটি ৯৩ লক্ষ টন পাম ও পাম কার্নেল তেল উৎপাদন করে এবং প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ টন রফতানি করে। প্রধান আমদানিকারক দেশগুলো হলো- ভারত, চীন, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তান, তুরস্ক, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, জাপান এবং ইতালি।

বিশ্বের পাম তেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতি বছর গড়ে এই বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে যেখানে এক কোটি ৭৭ লাখ টন পাম তেলের চাহিদা ছিল, সেখানে ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ২১ লাখ টনে। ২০২০ সালে এই চাহিদা ৬ কোটি ৮০ লাখ টনে বেড়ে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। অপার সম্ভাবনাময় সাতছড়ি তেলমাছড়াতে অবস্থিত পাম-অয়েল শিল্পকে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে এলাকাবাসী মনে করেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পাম-অয়েল,পাম-অয়েল শিল্প,ভোজ্যতেল,সম্ভাবনাময় শিল্প
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist