শাহ্জাহান সাজু

  ১৮ মার্চ, ২০১৮

স্বপ্নযাত্রায় আরো একটি গর্বের পালক

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবারের জন্মবার্ষিকীর দিনটি আরো একটি কারণে বাঙালির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেটি হচ্ছে কয়েক দশক স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার পর বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেল উন্নয়নশীল দেশের। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিপত্র জাতিসংঘের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো পেল বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এই ঘোষণা-সংক্রান্ত চিঠি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের কাছে হস্তান্তর করেছে। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন যাত্রায় অর্জিত হলো আরো একটি গর্বের পালক।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতের হাতে চিঠিটি তুলে দেন সিপিডি সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস। সিডিপির ঘোষণার ফলে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করল। তবে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। গত ১৫ মার্চ সিপিডি জাতিসংঘ সদর দফতরে এডিসি ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন-সংক্রান্ত ঘোষণা প্রদান করে। সে অনুযায়ী, এই চিঠি হস্তান্তর করা হয়। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিপিডি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো, জাতিসংঘের এডিসি, এলএলডিসি (ভূ বেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ) ও সিডস (উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রসমূহ) সংক্রান্ত কার্যালয়ের উচ্চতম প্রতিনিধি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফেকিতামইলোয়া কাতোয়া উটইকামানু, জাতিসংঘে নিযুক্ত বেলজিয়ামের স্থায়ী প্রতিনিধি মার্ক পিস্টিন, তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি ফেরিদুন হাদি সিনিরলিওলু, ইউএনডিপির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যুরোর পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু এবং ইউএনডিপির মানবিক উন্নয়ন রিপোর্ট অফিসের পরিচালক সেলিম জাহান।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ওপর একটি ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন থেকে শুরু করে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা দেখানো হয় এতে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কীভাবে দেশ এগিয়ে চলছে এবং কৃত্রিম উপগ্রহও মহাকাশে পাঠাচ্ছে, তা দেখানো হয় ভিডিও চিত্রে। উঠে আসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে। এতে তুলে ধরা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রফতানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। তুলে ধরা হয়।

এতে আরো দেখানো হয়, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো কাজ দ্রত গতিতে কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রদর্শন করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বান, ‘আসুন দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমাদের সকলের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আপনাদের জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ এই প্রথম এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের সকল শর্ত পূরণ করেছে।’

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে। কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না—এই প্রতিশ্রুতি ধারণ করে আমরা শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের জন্য শুধু একটি স্লোগানই নয়, সারা দেশের মানুষ আজ এর সুবিধা পাচ্ছেন।’ এ সময় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উঠতে বাংলাদেশ সচেষ্ট বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার জন্য জাতিসংঘসহ বাংলাদেশের সব উন্নয়ন সহযোগীদের ধন্যবাদ জানান মাসুদ বিন মোমেন। চিঠি হস্তান্তরের পর সিপিডি সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের কাক্সিক্ষত বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সামাজিক খাতগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন এই উত্তরণের ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ করাকে সহজ করেছে। সিপিডি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো বাংলাদেশের গতিশীল রফতানি খাত, মানবিকসম্পদ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ব্যাপক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

জাতিসংঘের এলডিসি, এলএলডিসি ও সিডস্ সংক্রান্ত কার্যালয়ের প্রতিনিধি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উটইকামানু বলেন, দ্রারিদ্র্য হ্রাস ও উন্নয়নের অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়েছে। অনুষ্ঠানে বক্তব্যে অন্য দেশগুলোর কূটনীতিকরাও বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে জনগণ ও সরকারকে অভিনন্দন জানান।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ যে তিনটি সূচক কোয়ালিফাই করেছে; আগামীতে সেগুলোতে খারাপ করার কোনো কারণ নেই। কাজেই ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় চলে যাবে। তবে তখন এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার কারণে বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন—এখন যে নমনীয় শর্তে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যায়; সেটা পাওয়া কঠিন হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কাডানা থেকে যে, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি+ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হবে-ইত্যাদি। এগুলোর জন্য নতুন করে নিগোসিয়েট করতে হতে পারে। তবে আমি মনে করি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার যথেষ্ট সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে উৎপাদন ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে নতুন শিল্পায়নে মনোযোগ দিতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। পণ্যের মান বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স আহরণের জন্য নতুন বাজার খুঁজতে হবে। এছাড়া সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষণা ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমাদের অর্থনীতি ইতোমধ্যে একটি জায়গায় পৌঁছে গেছে। সেটারই একটি স্বীকৃতি আমরা পেয়েছি। অর্থাৎ আমাদের অর্থনীতির ভিত যে শক্তিশালী হয়েছে; সেটারই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এখন এটাকে ধরে রেখে আমাদের আরো সামনের দিকে এগোতে হবে। আমাদের মানবসম্পদের আরো উন্নতি করতে হবে; জনগণের মাথাপিছু আয় আরো বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে হবে। যাতে উন্নয়নের এই সুফলটা সকলে পান।

তিনি আরো বলেন, আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে আমরা দাতা সংস্থা বা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ভবিষ্যতে হয়তো বা নমনীয় কিংবা সহজ শর্তে ঋণ পাব না। কিন্তু এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমাদের হাতে এখনো প্রায় ছয় বছর সময় আছে। তাছাড়া দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকলে; ধনী হলে এসবের প্রয়োজন পড়বে না বলে মনে করেন তিনি।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক)-এর মানদণ্ড অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে এক হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন এক হাজার ২৭৪ ডলার। ইকোসকের মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের আছে ৭২। অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এই পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়, ৩২-এ আনার পর উন্নয়নশীল দেশে যোগ্যতা অর্জন হয়। বাংলাদেশকে অবশ্য সূচকের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২০২২ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘের নির্ধারিত নিয়মে সূচকের তথ্যগুলোর সমন্বয়ে চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করা হবে। ২০২৪ সালের মার্চে সিডিপির নতুন বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন হলে তা পাঠানো হবে ইকোসোকে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত করে জাতিসংঘে প্রতিবেদন পাঠাবে ইকোসোক। সাধারণ অধিবেশনে তা স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এসব প্রক্রিয়ায় মোট ৬ বছর লাগবে। সেই পর্যন্ত বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তবে বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব সুযোগ সুবিধা পায় ২০২৭ সাল পর্যন্ত তা বহাল থাকবে। পরের বছর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। কারণ, ২০২৭ সালের পর বাংলাদেশ নিজেই একটি বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হবে। ফলে বাংলাদেশের আর বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না। সেজন্য হাতে এখনো যতটুকু সময় আছে, ওই সময়ের মধ্যে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
উন্নয়নশীল দেশ,বাংলাদেশ,স্বপ্নযাত্রা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist