শাহ্জাহান সাজু
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ
অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে
আজই পাওয়া যেতে পারে সেই কাঙ্ক্ষিত সুখবর। স্বাধীনতার পর এটিই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। সেটি হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। যা সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য গত সোমবার জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ২০তম অধিবেশন বসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। ১২ থেকে ১৬ মার্চ নিউইয়র্কে সিডিপির ওই অধিবেশনে এলডিসিগুলোর গত ৩ বছরের আর্থসামাজিক খাতের অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। কাঙ্ক্ষিত ওই প্রতিবেদনেই বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের যুগান্তকারী ঘোষণা আসবে।
এদিকে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে গেলে বাংলাদেশের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আসবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশ এখন যে রেয়াতি বা নমনীয় সুদে ঋণ পায়, বৈদেশিক সাহায্য পায়, সেখান থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও কানাডার বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হবে। অর্থাৎ যেসব শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেয়ে আসছে সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শুল্ক দিয়ে রফতানি করতে হবে। এতে রফতানি ব্যয় বেড়ে যাবে। এজন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোসহ পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এখন যেটি হবে; সেটি হলো বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। অর্থাৎ যে তিনটি সূচকের কথা বলা হচ্ছে; সেগুলো কোয়ালিফাই করবে। তবে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন—এখন যে নমনীয় শর্তে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যায়; সেটা পাওয়া কঠিন হবে, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হবে ইত্যাদি। তবে আমি মনে করি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার যথেষ্ট সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। তিনি আরো বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উৎপাদন ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে নতুন শিল্পায়নে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। রেমিট্যান্স আহরণের জন্য নতুন বাজার খোঁজতে হবে। এছাড়া সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য তিনটি সূচক বিবেচনা করা হয়। তিন বছরের গড় মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক। সরকারি বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সিডিপির বৈঠকে বাংলাদেশের ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ এই তিন বছরের সূচকের তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হবে। একটি দেশকে উন্নয়নশীল তালিকাভুক্ত হতে মানবসম্পদ উন্নয়নে ১০০ এর মধ্যে ৬৬ পয়েন্ট থাকতে হয়। তবে বাংলাদেশের রয়েছে ৬৮ দশমিক ৭ পয়েন্ট। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতায় ৩২ পয়েন্টের নিচে থাকতে হয়; বাংলাদেশ রয়েছে ২৫ দশমিক ১১ পয়েন্টে। আর জাতীয় মাথাপিছু আয় (জিএনআই) ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়। তবে বাংলাদেশ এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে ১ হাজার ৬১০ ডলারে। বাংলাদেশকে অবশ্য সূচকের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২০২২ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘের নির্ধারিত নিয়মে সূচকের তথ্যগুলোর সমন্বয়ে চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করা হবে। ২০২৪ সালের মার্চে সিডিপির নতুন বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন হলে তা পাঠানো হবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলকে (ইকোসোক)। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত করে জাতিসংঘে প্রতিবেদন পাঠাবে ইকোসোক। সাধারণ অধিবেশনে তা স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এসব প্রক্রিয়ায় ৬ বছর লাগবে। সেই পর্যন্ত বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তবে বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব সুযোগ-সুবিধা পায় ২০২৭ সাল নাগাদ এসব সুবিধা বহাল থাকবে। পরের বছর থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে জিএসপিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। কারণ ২০২৭ সালের পর বাংলাদেশ নিজেই একটি বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হবে। ফলে বাংলাদেশের আর বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজন পড়বে না। সেজন্য হাতে এখনো যতটুকু সময় আছে, ওই সময়ের মধ্যে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেছেন, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ওডিএ) হিসেবে যেসব ঋণ পায়, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলে সেসব ঋণের শর্ত কঠিন হয়ে যাবে। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ এখন রফতানিতে বিশেষ ভর্তুকি দিয়ে থাকে, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে রফতানিতে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ উন্নত বিশ্ব থেকে অনুদান পেয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে সেই অর্থায়নও বন্ধ হবে। এলডিসিভুক্ত হওয়ায় জাতিসংঘকে কম চাঁদা দিতে হয় বাংলাদেশকে। উন্নয়নশীল দেশ হলে চাঁদার হার দ্বিগুণ হবে। এছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় অংশ নিতে সরকারি প্রতিনিধিদল বিনা পয়সায় যাওয়ার যে সুযোগ পেয়ে থাকে সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
জানা যায়, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অর্জনটি উদ্যাপনের জন্য এরই মধ্যে সরকারের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার সুখবর পেলে আগামী ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হতে পারে। ওইদিন আতশবাজি পোড়ানো হবে। রাজধানীর সড়কগুলো রঙিন বাতি দিয়ে সাজানো হবে, সড়ক ও স্থাপনাগুলো সাজবে লাল-সবুজ পতাকায়। এর পাশাপাশি মন্ত্রণালয়গুলোর পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া পরিকল্পনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
পিডিএসও/হেলাল