রবিউল আলম ইভান, কুষ্টিয়া

  ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

ছোট ইটে মালিকের পকেট ভারী : ক্রেতার সর্বনাশ

কুষ্টিয়ায় তৈরি হচ্ছে ছোট মাপের ইট। এই ইট কিনে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন ঠিকাদার ও বাড়ি নির্মাতারা। বিপরীতে জেলার ১৪৯টি ইটভাটায় এক মৌসুমে উৎপাদিত ৩৮ কোটি ২৫ লাখ ইট বিক্রয় করে ক্রেতাদের ঠকিয়ে ৫০ কোটি টাকা লুফে নিচ্ছেন ভাটা মালিকরা, এতে তাদের পকেট দিনকে দিন ভারীই হচ্ছে। এই জোচ্চুরি দেখার কেউ নেই।

এই প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ভোক্তভোগীরা। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর বলেছে, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটির জনবল সংকট রয়েছে। ল্যাবরেটরি টেস্টেও ইটভাটা মালিকদের এই জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বাড়ি নির্মাণে হাত দিয়েছেন কুষ্টিয়া শহরের কোর্টপাড়াস্থ আইনজীবী শামীমুল হাসান অপু। তিনি বলেন, আমার ১২শ বর্গফুটের এক ইউনিটের ভবন করতে প্রকৌশলীর কাছ থেকে ড্রয়িং, ডিজাইন, নির্মাণ সামগ্রীর পরিমাণগত নির্দেশনা ও প্রাক্কলন ব্যয়ের ধারণা নিয়ে বাড়ির কাজে হাত দিয়েছি। কিন্তু ৩০ হাজার ইটের স্থলে আমাকে কিনতে হয়েছে ৪০ হাজার ইট। এখানেই আমার ৮০ হাজার টাকা বেশি লেগে গেছে। এছাড়া সিমেন্ট বালু ও লেবারসহ আনুষঙ্গিক খাতেও বেশি খরচ লেগে যায়। বিষয়টি প্রকৌশলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি ইট সাইজে ছোট হওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ঠিকাদার গোলাম মহসিন বলেন, সরকারি দরপত্রের প্রাক্কলন ব্যয় ধরে কাজ করতে গিয়ে সবদিক দিয়ে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। শিডিউল মতে, ইটের সংখ্যা ধরে কোনো মতেই নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। সড়ক কিংবা ভবন নির্মাণে একদিকে ইটের সংখ্যা বেশি লাগছে, ইট ভেঙে খোয়া তৈরির সময়ও পরিমাণে বেশি সংখ্যক ইট এবং সিমেন্ট-বালুও বেশি লাগছে। এতে ঠিকাদারি কাজে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।

নির্মাণ শ্রমিক আসাদুল মিঞা বলেন, কেবল ইটের সাইজ ছোট হওয়ায় মালিকরাই লোকসান দিচ্ছেন না, লেবার বেশি লেগে যাওয়ায় চুক্তিভিত্তিক কাজে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ছি। যে দেয়াল ১ হাজার ইটে হওয়ার কথা সেই ওয়াল নির্মাণে ১২শ ইটের কাজ করতে হচ্ছে। যে নির্মাণ শ্রমিকরা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন তাদের সময় বেশি লাগচ্ছে, মজুরিতে তারা পোষাতে পারছেন না।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ কুষ্টিয়ার ল্যাব ইনচার্জ উপ-সহকারী প্রকৌশলী তানভির আহমেদ বলেন, সরকারি স্ট্যান্ডার্ড সাইজ অনুযায়ী একটি ইট হতে হবে সাড়ে ৯ ইঞ্চি বাই সাড়ে ৪ ইঞ্চি বা ১১৭ দশমিক ৫৬ ঘন ইঞ্চি। কিন্তু বাস্তবে ল্যাব টেস্টে দেখা গেছে, ইট প্রস্তুতকারী ভাটা মালিকরা যেসব ইট ক্রেতা বা ভোক্তাদের কাছে বিক্রয় করছেন তা অধিকাংশই ৯৫ থেকে ৯৮ ঘন ইঞ্চি। এতে প্রকৌশলীরা ড্রয়িং ডিজাইন ধরে যত নিখুঁত এস্টিমেটই করুন না কেন কোনো লাভ হবে না। ইট মাপে ছোট হওয়ার কারণে অবকাঠামো নির্মাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

গণপূর্ত বিভাগ কুষ্টিয়ার উপ-সহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারিভাবে গণপূর্ত বিভাগ থেকে ইটের সঠিক সাইজের নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় আমাদের ঠিকাদাররা এসে অভিযোগ করে বেশি সংখ্যক ইট লেগে যাওয়ার কথা জানান। এই দায় কেবল অসাধু অতি মুনাফালোভী ভাটা মালিকদের। তারা সহজে বেশি মুনাফা লাভের পথ খুঁজতে নির্ধারিত মূল্য নিলেও ছোট সাইজের ইট দিয়ে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন। এর ফলে অবকাঠামো নির্মাণে অন্যান্য উপকরণের খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইট সাইজে ছোট করার কথা স্বীকার করেই কুষ্টিয়া জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলার বাড়িয়া গ্রামের এমভি ব্রিকসের মালিক রুহুল আমীন আজম বলেন, এতে ভাটা মালিকের কোনো দোষ নেই। ক্রেতারা এক হাজার ইট কিনতে ২ টাকা কম যেখানে পায়, সেখান থেকে ইট নিয়ে যায়। সে কারণে ভাটা মালিকরাও ইটের সাইজ ছোট করছেন। ব্যবসায়ের সুবিধা ও লাভ করতেই ভাটা মালিকরা আগেই ইটের ফর্মা ছোট-বড় করে থাকেন। এখানে সরকারি বিধিমালা থাকলেও কিছু করার নেই।

ইটের মাপ নির্ধারিত মাপের চেয়ে ছোট করে ভোক্তা অধিকার আইন লঙ্ঘন করে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন ভাটা মালিকরাÑএমন কথা স্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানালেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক মো. সেলিমুজ্জামান। তিনি আরো বলেন, কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ১৪৯টি।

এক মৌসুমে প্রতিটি ভাটায় গড়ে ২৫ লাখ ইট উৎপাদান করে বিক্রি করেন ভাটা মালিকরা। ইটের নির্ধারিত মাপ অনুযায়ী সাড়ে ৯, সাড়ে ৪ এবং পৌনে ৩ ইঞ্চি বা ১১৭ দশমিক ৫৬ ঘন ইঞ্চি হওয়ার কথা। ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা ইটের প্রাপ্ত গড় মাপ ৯০ থেকে ৯৮ ঘন ইঞ্চি হওয়ায় প্রতিটি ইটের দাম ৮ টাকা দাম ধরে ১ টাকা ৩১ পয়সা ক্রেতাকে ঠকিয়ে এক মোসুমে মোট উৎপাদিত ৩৭ কোটি ২৫ লাখ ইট বিক্রয় করে ভাটা মালিকরা ৪৮ কোটি ৭৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ছোট ইট,বাড়ি নির্মাতারা,ছোট মাপের ইট,ঠিকাদারি,কুষ্টিয়া
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist