হাসান ইমন

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৮

সিন্ডিকেট বাড়াচ্ছে সবজির দাম

মৌসুমি শাক-সবজিতে ভরা বাজার। প্রতিটি দোকানে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। সরবরাহ বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে উৎপাদনও। কিন্তু তারপরও দাম কমছে না। গত বছরের এই সময় দাম নাগালের মধ্যে থাকলেও এ বছরের চিত্র উল্টো। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই কিছু সবজির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। পাইকারির সঙ্গে খুচরা বাজারে দামের ব্যবধান বেড়ে গেছে অনেক। নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। দামের এই বড় ফারাকের জন্য সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবকে দায়ী করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দুই সপ্তাহ আগে টানা ৫-৬ দিন দেশজুড়ে ঘন কুয়াশা পড়েছিল। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের সব জেলায় কুয়াশা বেশিই পড়েছে। ফলে শাক-সবজির উৎপাদনে এর প্রভাব পড়েছে। কারণ বেশি শীত ও কুয়াশা পড়ায় সবজির গ্রোথ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে সবজির আকার ছোট হয়ে যায়। ফলে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটেছে। বাজার সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ দাম বাড়িয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ সবজি কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছরের এই সময়ে ছিল ২০-৩০ টাকার মধ্যে। রাজধানীর বাজারে এখন সবচেয়ে দামি সবজি লাউ। মহাখালী কাঁচাবাজারে গতকাল প্রতিটি বড় লাউ ৮০-১০০, মাঝারি লাউ ৬০-৮০ ও ছোট লাউ ৫০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা দু’সপ্তাহ আগে ছিল ৩০-৫০ টাকার মধ্যে। একই অবস্থা সবার পছন্দের তরকারি ফুলকপিরও। গত মাসের শেষের দিকেও বাজারে এই

সবজিটি বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস ২০-২৫ টাকা। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। একই অবস্থা কাঁচামরিচেরও। দুই সপ্তাহ আগে যে কাঁচামরিচ ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জামালপুর থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ২০০ পিস ফুলকপি নিয়ে এসেছেন পাইকারি ব্যবসায়ী সাত্তার মিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ফুলকপির সব খরচ দিয়ে বাজারে আনতে প্রায় ২৫ টাকা পড়েছে।’ দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ফুলকপির প্রথম ধাপের চাষ শেষ পর্যায়ে। এ কারণে তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। ঠান্ডার কারণে ফলনও কমে গেছে। তবে খুচরা বাজারে অনেক বেশি দরে বিক্রি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

পাইকারি দামের চেয়েও অর্ধেক দাম পাচ্ছেন কৃষকরা। গতকাল জামালপুরের কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, গত দুই দিন আগে ১০০ পিস ফুলকপি বিক্রি করেছেন। আকারভেদে প্রতিটি ১৫-১৮ টাকা দাম পেয়েছেন। যা দুসপ্তাহ আগেও ছিল ৮-১০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে প্রতিটি ফুলকপির দাম ৭-৮ টাকা বাড়লেও খুচরা বাজারে ক্রেতাদের দাম গুনতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফার প্রবণতা বেড়েছে। আর ভোক্তারা বেশি দাম মেনে নিতে অভ্যস্ত হচ্ছেন। এ বিষয়ে ভোক্তাদের প্রতিবাদ করা উচিত। সামান্য অজুহাত পেলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। শীতের কারণে ফলন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। এতে এত দাম বৃদ্ধির কথা নয়।

তিনি আরো বলেন, দেশে সবজির উৎপাদন কিছুটা কম হলেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে দাম এত বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তখন বেশি দাম বাড়িয়ে বিক্রির সুযোগ থাকবে না। তবে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে তাদের সমবায় সমিতি করে সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এটি হলে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ হবে। কৃষক ও ভোক্তা উভয়ে লাভবান হবে।

এই বিশ্লেষক আরো বলেন, খুচরা বাজারের একচেটিয়া মুনাফা করার সুযোগ থাকায় দামের ব্যবধান বেশি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা আইন বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

সবজি ব্যবসায়ীরা শাক-সবজির দাম বাড়ার পেছনে শীতের প্রকোপকে কারণ হিসেবে দেখালেও ক্রেতারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। মহাখালী কাঁচাবাজারে কেনাকাটা করতে আসা রসুলবাগের বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন, মহল্লার দোকানের তুলনায় এখানে সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে অন্তত ১০ টাকা কম পাওয়া যায়। আজ (গতকাল) দেখছি সব ধরনের সবজির দামই বাড়তি। গত সপ্তাহে মহল্লায় যে দাম ছিল, তা বাজারে এসে মহল্লার চেয়ে বেশি দাম দেখতে পাচ্ছি।

শুধু লাউ ও ফুলকপি নয়, শীতের বাঁধাকপি, শিম, বরবটি, টমেটো, গাজরসহ সব সবজির দাম বেশি। ফুলকপি দুসপ্তাহে দ্বিগুণ হয়েছে। গতকাল খুচরায় প্রতিটি বাঁধাকপি আকারভেদে ২৫-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা দুসপ্তাহ আগে ছিল ১৮-২২ টাকা। গত বছরের একই সময়ে ১০-১৫ টাকা ছিল। এ ছাড়া ৫০ টাকা কেজি বরবটি এখন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছরে ছিল ৪০ টাকা। এখন টমেটো, শিম ও বেগুন কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা। দুসপ্তাহ আগে টমেটো, শিম ও বেগুন ছিল ৩০-৪০ টাকা কেজি। গত বছরের একই সময়ে এসব সবজির দাম ২০-৩০ টাকার মধ্যে ছিল। দুসপ্তাহের ব্যবধানে ৪০ টাকা কেজি করলার দাম দ্বিগুণ বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। গত বছরের এই সময়ে করলা বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে। অন্যান্য সবজির দামও বাড়তি।

সবজির পাশাপাশি শাকের দামও বাড়তি। বর্তমানে লাউ শাকের আঁটি ৪০ টাকা। যা গত বছর ছিল ১০-১২ টাকা। এখন মুলাশাক, লালশাক, পালংশাক ও সরিষাশাক ১০-১২ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, পাইকারি বাজারের সঙ্গে মিল রেখেই তারা বিক্রি করছেন। আড়তে দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরায় দাম বেড়েছে। মহাখালী কাঁচাবাজারের বিক্রেতা আবুল কালাম বলেন, সবজির দাম বাড়লে তখন পাইকারির সঙ্গে খুচরায় দামের তফাৎ তৈরি হয় কিছুটা। দামের ওঠানামা থাকলে বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। এ কারণে খুচরায় অতিরিক্ত দাম মনে হতে পারে।

এই বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিতত্ত্ব ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফুর রহমান বলেন, ঘন কুয়াশা ও অতিরিক্ত শীতের কারণে ফসলের যা ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বহু গুণ দাম বাড়িয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজার সিন্ডিকেট চক্র। কারণ বিভিন্ন জেলা থেকে তিন থেকে চার হাত ঘুরে সবজি কিনতে পায় ক্রেতারা। এরপর সিন্ডিকেট চক্র নির্দিষ্ট করে দাম। এ সমস্যা সমাধানে এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, কৃষক যাতে বাজারের পাইকারদের কাছে সহজে সবজি বিক্রি করতে পারে সরকারকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের আওতায় আনা যায়, তাহলে বাজার সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সবজি,বাজার,সিন্ডিকেট,কৃষি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist