নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮

ডলারের চাহিদা বাড়ছে, পাচারের আশঙ্কা

ডলারের ব্যাপক চাহিদার মধ্যে মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা কমিয়ে আনার চেষ্টায় ডলার ছেড়েই চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১২৫ কোটি ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে। এরমধ্যে গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবারই বিক্রি করা হয় চার কোটি ডলার। তাতে লাভ খুব বেশি হচ্ছে না।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ওই দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছে। আর তারা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করার সময় নিয়েছে আরো বেশি। কোনো কোনো ব্যাংক ৮৪ টাকার বেশি দামেও ডলার বিক্রি করেছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান গত এক বছরে ক্রমাগত কমছে। তাতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয়ে ‘ইতিবাচক’ প্রভাব পড়লেও আমদানিতে খরচ বেড়েছে। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি বাড়ার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আমদানির তথ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচারকেও এর একটি কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

মান হারাচ্ছে টাকা : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার বা অন্য মুদ্রা কেনাবেচা করে তাকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার বলা হয়। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে এক থেকে দেড় টাকা বেশি দামে ডলার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করলেও অগ্রণী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক ৮৪ টাকা, জনতা ব্যাংক ৮৪ টাকা ১০ পয়সা, আইএফআইসি ব্যাংক ৮৪ টাকা ৪৫ পয়সা এবং এবি ব্যাংক ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করেছে ডলার।

এক বছর আগে এই এক ডলারের জন্য লাগত ৭৮ টাকা ৯০ পয়সা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। ছয় মাসের ব্যবধানে কমেছে প্রায় তিন শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাসে (২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি) পর্যন্ত ১২৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ গত অর্থবছরের এই সময়ে বাজার স্থিতিশীল থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোনো ডলার বিক্রি করতে বা কিনতে হয়নি।

ওই কর্মকর্তা বলেন, যখন যেটা প্রয়োজন সেটাই আমাদের করতে হয়। যখন সরবরাহ বেশি ছিল তখন আমরা বাজার থেকে ডলার কিনেছি। এখন চাহিদা বাড়ায় বিক্রি করছি। এটাই স্বাভাবিক।

যে কারণে বেড়েছে ডলারের দর : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সরঞ্জামের আমদানি বেড়েছে। আমদানি খরচ মেটাতে ডলারের চাহিদাও বেড়েছে, ফলে ‘স্বাভাবিক কারণেই’ বাড়ছে ডলারের বিনিময় হার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি ব্যয় যেখানে ২৯ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে রফতানি আয় ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং রেমিটেন্স ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।

রেমিটেন্স ও রফতানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরো আগে কমানো দরকার ছিল বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের বিপরীতে টাকা অতিমূল্যায়িত ছিল। ভারত ও ভিয়েতনামসহ বাংলাদেশের প্রতিযোগী বিভিন্ন দেশ আগেই তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। আমরা অনেক দেরিতে এই কাজটি করছি। তবে টাকা যেন খুব বেশি দুর্বল হয়ে না যায়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।

পাচার হচ্ছে : বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের ধারণা, আমদানি বাড়ার পাশাপাশি ‘প্রচুর অর্থ’ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ কথা ঠিক যে আমদানি বাড়ার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে; রফতানি আয় তার চেয়ে অনেক কম হারে বাড়ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহের গতিও খুব বেশি নয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় স্বাভাবিকভাবেই দর বাড়ছে।

কিন্তু উদ্বেগের বিষয়টি হলো, বিরাট একটা অংশ বিদেশে পাচার হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থার বরাত দিয়ে ফরাসউদ্দিন গতবছর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। আহসান মনসুর বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এটা হয়ে আসছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ কারণে এটা আরো বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সজাগ দৃষ্টি দরকার।

যেভাবে পাচার হচ্ছে : পিআরআইর নির্বাহী পরিচালকের মতে, কোনো কারণে অনিশ্চয়তা বাড়লে অর্থ পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। রাজনৈতিক দলের নেতারা যেমন পাচার করেন, তেমনি ব্যবসায়ী বা আমলারাও অর্থ বাইরে নিয়ে যান। আর এক শ্রেণির লোক পারিবারিকভাবেই বিদেশে অবস্থানের জন্য অর্থ পাচার করে। এ কারণ আমরা বিদেশে ‘বেগম পাড়া’ গড়ে ওঠার খবর পাই। আহসান মনসুর বলেন, বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে মূলত তিন ভাগে। প্রবাসীদের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স দেশে আসার কথা সেটা না এসে তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে তা কানাডা-আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। যে রেমিটেন্স ব্যাংকিং চ্যানেলে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা, তা দেশে না এসে বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি পথ হচ্ছে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস দেখানো। অর্থাৎ যে দামে পণ্য কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে বাড়তি অর্থ বিদেশে পাচার হয়। আবার যে পণ্য আমদানি হওয়ার কথা, তার বদলে কম দামি পণ্য আনা অথবা খালি কন্টেইনার আনার ঘটনাও ধরা পড়েছে কখনো কখনো।

আবার পণ্য রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়। যে পণ্যের দাম ১০০ ডলার, ক্রেতার সঙ্গে বোঝাপড়া করে তা ৭০ ডলার দেখিয়ে রফতানি করেন ব্যবসায়ী। বাকি ৩০ ডলার তিনি বিদেশি সেই ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে তা বিদেশেই রেখে দেন। ২০১২ সালের প্রথম দিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর থেকে তা কমতে কমতে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৮০ টাকার নিচে নেমে আসে। ২০১৭ সালের প্রথম দিকেও ডলারের দর ছিল ৮০ টাকার নিচে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ৮০ টাকা ছাড়ায়; এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।

২০০৩ সালে দেশে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা (ফ্লোটিং) চালু হয়। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তার আগ পর্যন্ত টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করে দিত।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ডলার,মুদ্রাবাজার,কেন্দ্রীয় ব্যাংক,ডলারের চাহিদা,ডলার পাচার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist