নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮

নতুন মজুরি বোর্ড

কত বেতন পাবেন পোশাকশ্রমিকরা

দেশে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আবারও ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। এই মজুরি বোর্ড ছয় মাসের মধ্যে শ্রমিকদের জন্য একটি নতুন বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। তবে এই বেতন কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, শ্রমিকদের বেতন বাড়লে কত বাড়বে?

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসেবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য মূলত তিনটি মডেলকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর প্রথম মডেলটি হচ্ছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থানকারী একজন শ্রমিকের মাসিক খরচের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। দ্বিতীয় মডেলটি হলো, কাক্সিক্ষত পুষ্টি অর্জনের জন্য একজন মানুষের যে সুষম খাবার, তা বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। তৃতীয় মডেলটি হলো, শ্রমিকদের বর্তমান জীবনধারণের খরচের হিসাব বিবেচনা করে তার ওপর ভিত্তি করে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা।

সিপিডি বলেছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ‘জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এ ক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা। সিপিডির হিসেবে পরবর্তী দুটি মডেলে এই পরিমাণ আরো বাড়ে। কাক্সিক্ষত পুষ্টিহার অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকের প্রতি মাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। প্রকৃত খরচ অনুযায়ী বিবাহিত একজন শ্রমিকের মাসে আয় করতে হবে ১০ হাজার ৩৫২ টাকা।

গত ২০১৩ সালের নভেম্বরে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে সরকার। ঘোষণার এক মাস পর ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। সে অনুযায়ী এন্ট্রি লেভেলে বর্তমানে একজন শ্রমিক ন্যূনতম পাচা হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। এ ছাড়া বছরে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা আছে। দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর পর পর ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনা করা যায়। এ ছাড়া বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় যেকোনো পর্যায়ে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার নিয়ম আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ৫ বছরের আগেই সরকার স্বেচ্ছায় মজুরি বোর্ড গঠন করল।

সরকারের একটি স্থায়ী ন্যূনতম মজুরি বোর্ড রয়েছে। চার সদস্যের সেই বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। এই বোর্ডের অন্য তিন সদস্য হলেন মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশ এমপ্লায়ার্স ফেডারেশনের শ্রম উপদেষ্টা কাজী সাইফুদ্দীন আহমদ, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশ শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক মন্টু, নিরপেক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন। রোববার পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে গঠিত স্থায়ী মজুরি বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার বেগম।

নতুন মজুরি বোর্ড প্রসঙ্গে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই কমিটি পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন কাঠামো যাচাই-বাছাই করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে। এরপর সরকার পোশাক শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করবে।’

বিজিএমইএ সভাপতি ও মজুরি বোর্ডের সদস্য সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বোর্ড বসেই ঠিক করবে। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর জন্য আমরাই সরকারকে বোর্ড গঠনে চিঠি দিয়েছি।’

শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে গত ৮ নভেম্বর তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ পোশাক খাতের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়। বিজিএমইএর এই উদ্যোগকে সরকার ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বলে মন্তব্য করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক।

সাভারের এ আর গার্মেন্টসের শ্রমিক শাহানাজ খানম বলেন, ‘যে বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চলে না। মালিকরা সব সময় বেতনের সঙ্গে ওভারটাইম ধরে বেতন বোঝান। ওভারটাইম তো বেতন নয়। যদি একজন শ্রমিক ওভারটাইম না করেন, তাহলে তো তিনি ওভারটাইমের বিল পাবেন না। বর্তমান বাজারে ন্যূনতম বেতন হওয়া প্রয়োজন কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা বলেও তিনি মনে করেন।

আশুলিয়ার গার্মেন্টস মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘পোশাকশ্রমিকরা আমাদের পরিবারের সদস্য। তারা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকি। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে বেতন বাড়ানো উচিত। এটা সময়ের দাবি। মালিকদের বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্যও।’

এদিকে দেশের অর্থনীতিবিদরা অভিযোগ তুলেছেন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জীবনধারণকেই কেবল গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাদের ভবিষ্যৎ জীবন, সঞ্চয়, সন্তানদের পড়াশোনা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখা হয় না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেছেন, “বিদ্যমান শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির মোট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের পাওনা।

এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন এবং ১০ শতাংশ কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ও বাকি ১০ শতাংশ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। তৈরি পোশাক কারখানায় এর কিছুই মানা হয় না। এটা অনেক পুরনো আইন। ‘বিলস্’-এর অর্থায়নে ২০০৯ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছিলাম, মালিকরা যদি তাদের অর্জিত মুনাফার মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দিতেন তাহলেই প্রতি বছর সেখানে ৩০০ কোটি টাকা জমা হতো। এ দিয়ে শ্রমিকদের জন্য নতুন নতুন বাসস্থানসহ নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া যেত। অনেক সমস্যার সমাধান হতো। কিন্তু তারা সমাধান চান না। তারা চান শুধু মুনাফা।”

উল্লেখ্য, দেশে এর আগে তৈরি পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর। তিন হাজার টাকা মূল বেতন ধরে ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হয়েছিল তখন। নতুন কাঠামোয় ওই বেতন তারা পাচ্ছেন ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে। যা অব্যাহত রয়েছে।

বিদ্যমান বেতন কাঠামোয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির মধ্যে মূল বেতন ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া ১ হাজার ২৮০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ৩২০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ২০০ টাকা যাতায়াত ভাতা এবং খাদ্য ভর্তুকি বাবদ রয়েছে ৩০০ টাকা। ন্যূনতম মজুরি বিধিমালা-১৯৬১-এর সপ্তম ধারা অনুযায়ী সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে তৈরি পোশাকশিল্পের এই ন্রূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে।

এদিকে গত কয়েক বছরের মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন হতে হবে ১৬ হাজার টাকা।

২০১২ ও ২০১৩ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে আসে। পরে বিদেশি ক্রেতাদের চাপে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বৈশ্বিক পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি-২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এখন ৬৮ ডলার, ভারতে ৭৮, ইন্দোনেশিয়ায় ৯২, পাকিস্তানে ৯৯, কম্বোডিয়ায় ১২৮ ও মালয়েশিয়ায় ২২৫ ডলার।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পোশাক খাত,পোশাক শ্রমিক,মজুরি বোর্ড
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist