reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৩ জুন, ২০১৬

লাতিন আমেরিকা

বিপরীত স্রোতে গোলাপী বিপ্লব

চন্দন সরকার

সহ¯্রাব্দের শুরুতে লাতিন আমেরিকায় যে ‘গোলাপি ¯্রােতের’ সূত্রপাত ঘটেছিল তা হঠাৎ করেই থমকে গেছে। শুধু থমকে যায়নি উল্টো ধারায় বইতেও শুরু করেছে। কিন্তু কী এমন ঘটেছে যে, মাত্র দুই দশকও পার হতে না হতেই এমনটি ঘটল। এই অঞ্চলের প্রগতিশীল সরকারগুলো প্রায় দুই দশক আগে অর্থনৈতিক সাফল্যের যে ধারা সৃষ্টি করেছিল অভিযোগ উঠেছে তার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে দুর্নীতির ¯্রােত। আর এরই ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে আর্জেন্টিনায় ক্ষমতায় এসেছে ডানপন্থীরা। ব্রাজিলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র বা বেসামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বামপন্থী দিলমা রুসেফকে। অন্যদিকে এই অঞ্চলের ‘গোলাপি ¯্রােত’ সৃষ্টির সূতিকাগার ভেনিজুয়েলা এখন অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভেঙে পড়েছে। বিগত ছয় মাসের মধ্যে লাতিন আমেরিকার সমমনা প্রগতিশীল প্রেসিডেন্টদের শাসন যেন ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে।

হঠাৎ করেই যেন বিপরীত স্রোতের অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা উপরে উঠে এসেছে। সমগ্র অঞ্চলে আদালতের তদন্ত শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় এই তদন্তে তোলপাড় শুরু হয়েছে ক্ষমতা বলয়ে। ফলে এই এলাকার বামপন্থী সরকারগুলো সমাজ বিনির্মাণে যে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিল কিংবা যে জিজ্ঞাসার সূত্রপাত করেছিল তা প্রবল ঝাঁকুনির শিকার হয়েছে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলের লুটেরা ধনীরা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা করে আসছিল, তা যেন সফল হতে চলেছে। অন্তত তারা তেমনটিই মনে করছে। তারা আশা করছে শিগগিরই সদলবলে সবকিছু আবার করায়ত্ত করতে পারবে।

কিন্তু কেন এমনটি হলো? দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দুই অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। দুটি দেশই দীর্ঘদিন অর্থাৎ পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশক জুড়ে ছিল সামরিক শাসনের অধীন। ১৯৮০-এর দশক ছিল এ দুটি দেশে সামরিক শাসনের সমান্তরালে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের আন্দোলনে উদ্বেলিত। ১৯৯০-এর দশকে দুটি দেশই মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করে, যা তাদের সে সময়কার মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহতা থেকে সাময়িক হলেও কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যায় এই সাফল্য ফাঁপা। সহস্রাব্দের শুরুতেই দুটি দেশ পুনরায় মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে পড়ে এবং মুদ্রামান বড় ধরনের হ্রাস করে দুটি দেশই। মুদ্রামান এতটাই হ্রাস পায় যে দুটি দেশের অর্থনীতিই পুনরায় অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়।

এ রকম একটি বিশৃঙ্খলা ও গোলমালের মধ্যে গণআন্দোলনের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন ব্রাজিলে শ্রমিক নেতা লুলা ডি সিলভা এবং আর্জেন্টিনায় নেস্টর ক্রিচনার। ২০০৩ সালে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ধারক তথাকথিত গণতান্ত্রিক ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় নির্বাচনে পরাজিত হয়ে। প্রবল জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়ে জনগণের বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন হন লুলা ডি সিলভা ও ক্রিচনার। তারা নতুন অর্থনৈতিক ধারা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেন এবং সমাজের উঁচু শ্রেণির একচেটিয়াত্ব থেকে ক্ষমতা শ্রমিক শ্রেণির হাতে ন্যস্ত করার কথা বলেন।

এই সময় বিশ্ব অর্থনীতির পালে নতুন বাতাস লাগে। লুলা ও ক্রিচনার দু’জনেই চীনের অর্থনেতিক বুমের সুবিধা পান। চীনে পণ্য রফতানির মাধ্যমে তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে তাদের বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা প্রচ-ভাবে হ্রাস পায়। স্বনির্ভরতার ওপর দাঁড়িয়ে তারা উভয়েই লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমা থেকে ওপরে টেনে তোলেন। একই সঙ্গে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল এই অঞ্চলের সামরিক তথা তথাকথিত গণতান্ত্রিক ধনীদের শাসনের পক্ষে। তাই দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা গ্রহণের ছিল বিরোধী। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়েই অপ্রতিবেশী সুলভ ও উপনিবেশবাদী। ফলে নতুন এই বামপন্থী শাসকদের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাবেও কোনো রাখঢাক নেই।

এসব কারণে লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী শাসনের সূত্রপাত যে ঘটিয়েছিলেন ভেনিজুয়েলার সেই হুগো শ্যাভেজের সঙ্গে হাত মেলান লুলা ও ক্রিচনার। তেলসমৃদ্ধ ভেনিজুয়েলার ক্ষমতায় এসেই তেলসম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এনে মার্কিন কোম্পানি ও দেশীয় লুটেরা বেনিয়াদের বিরাগভাজন হন শাভেজ। পাল্টা সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে হটাতে বার কয়েক চেষ্টা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু ব্যর্থ হয়। শ্যাভেজ সে সময় তেল থেকে পাওয়া আকাশচুম্বী রাজস্ব আয় দেশের দরিদ্র জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানে ব্যয় করেন। দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে তিনি স্বপ্ন দেখেন লাতিন আমেরিকান কিংবদন্তি পুরুষ সাইমন ডি বলিভারের সেই বলিভারিয়ান বিপ্লবের। অর্থাৎ লাতিন আমেরিকাকে একই বলয়ে নিয়ে আসার। তিনি কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে প্রধান করে একটি বামপন্থী জোট গঠনের উদ্যোগ নেন। লুলা ও ক্রিচনার জোটের বাইরে থেকেও শ্যাভেজের সঙ্গে হাত মেলান। লাতিন আমেরিকা সমাজবাদী ধারার এক প্রদোষ লগ্নে পা রাখে।

দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ সাধারণ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ যারা ভোট দিয়ে এদের ক্ষমতা আনেন তারা দুঃস্বপ্নের কাল কাটিয়েছেন ষাট ও সত্তর দশকে। সে সময় তাদের ‘মুক্তির আন্দোলন’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে শাসন ক্ষমতায় আসীন জেনারেলদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়েছে। খুনি এসব জেনারেলদের নির্মম নিষ্পেষণে এবং ঝরানো রক্তে মুক্তির আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশেই হাজার হাজার মানুষ শিকার হয়েছে গুম ও খুনের। কিন্তু বারবার মুক্তির সেই স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ‘গোলাপি-জোয়ার’-এ ভেসে যায় বিদেশি নির্ভরতায় চলা স্থানীয় সেনাশাসক ও ধনী এলিটদের নির্মম লুটপাটের শাসন।

ভেনিজুয়েলায় হুগো স্যাভেজের উত্তরসূরি মাদুরো ও বলিভিয়ায় আদিবাসী নেতা ইভো মোরালেস দেখিয়েছেন দেশের আয় করা সম্পদ দিয়ে সংস্কারের মাধ্যমে সমাজে দারিদ্র্য ও অসাম্য কমিয়ে আনা যায় এবং তাতে অর্থনীতির কোনো ক্ষতি হয় না। একই সঙ্গে এই দুয়ের পথ ধরে একই মতাদর্শে তিনটি দেশে তিনজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এরা হচ্ছেন আর্জেন্টিনার ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ, ব্রাজিলে দিলমা রুসেফ এবং চিলিতে মিশেল ব্যাচেলেট। এই তিনের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মনে হয়েছিল স্বপ্ন বোধহয় পূরণ হলো। কিন্তু সত্যি কি তাই?

ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় অর্থনীতির বড় ধরনের ধাক্কার কারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। তেলের দাম ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় বিশেষ করে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ায় লাতিন আমেরিকার রফতানি বাণিজ্য বড় ধরনের মার খায়। এই দুইয়ের চাপে অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত তখনই এসব দেশে বেসামরিক বা পার্লামেন্টারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের পথ নেয় সেই কায়েমি স্বার্থবাদী ধনিক এলিটরা। পেছনে মদদ রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর। কিন্তু এত কিছুর পরও চিলির ব্যাচেলেট ও বলিভিয়ার ইভো মোরালেস প্রমাণ করে চলেছেন দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনমূলক অর্থনৈতিক সংস্কার সবসময় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে না। বেশিরভাগ সময়েই চাঙ্গাও করে। প্রয়োজন উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার।

ব্রাজিলের রুসেফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে ইম্পিচমেন্টের ধারা, ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে ডানপন্থীদের ক্ষমতা দখল এবং আর্জেন্টিনার নির্বাচনে নির্বাচিত মধ্য ডানপন্থী নতুন প্রেসিডেন্ট মাওরিসিও ম্যাক্রি যে অছিলায় ক্ষমতায় এসেছেন তা থেকে তারাও কি মুক্ত? শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া এক অলীক কল্পনা। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই দুর্নীতির মাত্রা কোথায় কতটা এবং ব্যক্তিগত সম্পদে নিয়োগ হয়েছে কি না তা? লাতিন আমেরিকার আর্থ-রাজনৈতিক আকাশে উল্টো হাওয়ার প্রবাহ যারা শুরু করেছে তারা তাদের আনীত অভিযোগ থেকে নিজেরাও মুক্ত নয়। স¤প্রতি প্রকাশিত পানামা পেপারসই তার প্রমাণ। লক্ষণীয় রুসেফ দুর্নীতির এই তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াননি।

সবশেষে একটি কথা বলা যায় যে, দক্ষিণ আমেরিকার প্রগতিশীল জোট ক্ষমতা বলয়ে যে বর্তমানে বিপর্যস্ত হয়েছে তা তার আদর্শিক ভিত্তির দুর্বলতার কারণে নয়, বরং কারণ এটা গড়ে উঠেছে রক্ষণশীলদের রেখে যাওয়া কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে। দুর্নীতির ক্লেদ ছড়িয়েছেন তারাই যারা লাতিন আমেরিকার ক্ষমতার লড়াইয়ে বর্তমানে প্রগতিশীল বামপন্থীদের নাস্তানাবুদ করছেন। সেই ক্লেদের ছিটেফোঁটা লাগছে এসব নেতাদের গায়ে।

লেখক : সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist