reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৬ জুলাই, ২০১৬

বিশ্লেষণ

অসুস্থ রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের উত্থান

রেজাউল করিম খান

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে উদারপন্থি, মুক্তমনা লেখক, বিদেশি নাগরিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং হত্যাকা-ে দেশবাসী বিচলিত ও শঙ্কিত হয়েছে। তবে ১ জুলাইয়ের গুলশান ঘটনা সব মহলকেই ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। ওই ঘটনা প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে ধনী, দেশি-বিদেশি, বিশেষ এলাকার মানুষেরও নিরাপত্তা প্রশ্নাতীত নয়। হামলার পর পরই এর দায় স্বীকার করেছে ইসলামী স্টেট বা আইএস। বাংলাদেশে অনসার আল-ইসলাম বা আনসারুল্লা বাংলা টিম (এবিটি) ও জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের দুটি স্থানীয় জঙ্গি দল রয়েছে, যারা এ ধরনের হত্যাকা- চালাচ্ছে। ২০০৯ সালে এবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। এর আগে ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয় জেএমবিকে।

গুলশানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান শেষে ঘটনাস্থল থেকে একটি রুমাল উদ্ধার করা হয়। সাদা কাপড়ের ওই রুমালে বাংলায় কালো অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘দৌলাতুল ইসলাম বাংলাদেশ টিকে থাকবে’। তবে কি ওই নতুন সংগঠন হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়েছে? রুমালে লেখার মাধ্যমে তারা কি কোনো নতুন মেসেজ দিয়েছে? এই সংগঠনের নেতৃত্বে কারা আছে? তারা কি কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে? এসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না।

দেশি বা বিদেশি, যে সংগঠনই আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা করুক না কেন, তারা নিরাপত্তা বেষ্টনীকে পাশ কাটাতে সক্ষম হয়েছে। গুলি ও বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনে হতচকিত নিরাপত্তাকর্মীরা রেস্টুরেন্টে অবরুদ্ধদের জীবিত উদ্ধারের কৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হন। অবশেষে দীর্ঘ সময়ের পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র অভিযান চালনো হয়। অপারেশন থান্ডারবোল্ট শেষে কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও অধিকাংশ মানুষেরই মৃতদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ নিহত ৫ জঙ্গির নাম প্রকাশ করে। নামগুলো বেশ সুন্দর-আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন ও রিপন। পরে জানা যায় ওইসব নাম ছিল কাল্পনিক। ওরা উচ্চশিক্ষিত, অল্প বয়সী, ধনী ঘরের সন্তান।

আল-কায়েদা ও আইএস দুটি আলাদা সংগঠন। কিন্তু নতুন সদস্য সংগ্রহের কৌশল প্রায় একই। ইন্টারনেট অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উন্নয়নের কারণে সবকিছু মুহূর্তেই জানা সম্ভব হচ্ছে। আইএসের ম্যানুয়েলে বলা হয়েছে হতাশ, বিপন্ন ও কম ধর্মপ্রাণ তরুণদের মাথায় বিশেষ মতবাদ ঢোকানো সহজ হয়। হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় শহরের জনবিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থী ওদের টার্গেট। এসব তরুণের মন থাকে নিষ্পাপ। মুসলমানদের চলমান দুর্দশার বর্ণনা তাদের প্রভাবিত করে। এ সময় দেখানো হয় ফিলিস্তিনের ভিডিও। ধারণা দেওয়া হয় জিহাদ সম্পর্কে আর শহীদের জন্য বেহেশতপ্রাপ্তির সহজলভ্য। ওদের একাংশ শহীদ হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সাধারণ দলন-পীড়নের মাধ্যমে ওদের নিবৃত্ত করার সম্ভাবনা প্রশ্নাতীত নয়।

প্রচলিত অপরাজনীতিই জঙ্গিবাদ উত্থানের অন্যতম প্রধান কারণ। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, অনিয়ম, দুর্বৃত্তায়ন ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা বর্তমান প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ করে দিয়েছে। আজকের তরুণরা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। অথচ রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাজনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়ে থাকে মানুষ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সুস্থ ছাত্র রাজনীতি নেই। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের নামে চলছে চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কর্মকা-। বাম রাজনীতি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির এই নিষ্ক্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বর্তমান প্রজন্মের ওপর। সিংহভাগ শিক্ষার্থী নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। সংগঠন নেই তাই কর্মব্যস্ততাও নেই। সাহিত্য, নাট্যচর্চা নেই। খেলার মাঠ প্রায় শূন্য। হতাশায় নিমজ্জিত এক শ্রেণির তরুণ আসক্ত হচ্ছে মাদকের প্রতি। ভালো ছাত্ররা এখন রাজনীতি করে না। অথচ দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও শুভবোধকে জাগ্রত করার জন্য ছাত্ররাজনীতির বিকল্প নেই। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ছাত্রের মাথায় ঢোকানো হচ্ছে ইসলামের নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। এখন দেখা প্রয়োজন এর ফলে লাভ হচ্ছে কার? রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য মতামত পাওয়া যায়নি।

গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা গত ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, আর্টিজান রেস্টুরেন্টে আইএস নামধারী ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে বিদেশিসহ ২২ জন মানুষের নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনায় তারা বেদনাহত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। এর এক সপ্তাহ পর শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে সন্ত্রাসী আক্রমণে ৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করেছে, ধর্মান্ধ উগ্রবাদী শক্তির হাত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষও নিরাপদ নন। এরা মানবতাবিরোধী শক্তি। ইসলাম রক্ষার নামে অমুসলিম ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর হামলা চালিয়ে এরা জনগণকে বিভক্ত করতে চায়। সারা দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সরকার তার দায় এড়াতে পারে না। এসবকে সরকার ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে বিরোধী পক্ষের ওপর দোষ চাপাতে চাইছে। শাসকগোষ্ঠী সব সময় জঙ্গিবাদের সমস্যা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। এর সমাধান প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জঙ্গিবাদের সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে প্রয়োজন মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম এবং যুক্তিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ উদ্বিগ্ন। তবে এই জঙ্গি তৎপরতা এখনই দমন করা সম্ভব হবে, এমনটি আশা করছেন না কেউ। সরকারের মধ্যেও অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব সবাই তাদের অধীনস্তদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কাজ করতে বলেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মনে করেন, জঙ্গিবাদ যে এতটা গভীর, বিস্তৃত ও শক্তিশালী হয়েছে, তা পুলিশ হয় তো জানত না। এখন ওরা সমাজের ওপরতলায় আঘাত করছে। অতএব সবারই টনক নড়ার কথা। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের মনে করেন, গণতন্ত্রের ঘাটতি, সুশাসনের অভাব, বৈষম্য, হতাশা ও ক্ষোভ থেকে উগ্রপন্থার বিকাশ ঘটেছে। এরা ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশের চরমপন্থিদের সঙ্গে মিলে একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। গুলশান হামলার পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সব ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্যের মাধ্যমে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগেও তিনি জঙ্গিবাদ ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করলে বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। অবশ্য জঙ্গিবাদের মদতদাতা বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গি দমন করা সম্ভব নয় বলে কেউ কেউ মনে করেন। তা ছাড়া বিএনপি এখন সেমিনারে বক্তব্য আর বিবৃতি দেওয়ার পার্টিতে পরিণত হয়েছে। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করার শক্তি তাদের নেই। অনেকে মনে করেন, সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় জঙ্গিবাদ বিকশিত হয়েছে।

জঙ্গি হামলায় বিদেশি হত্যা ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বরে ঢাকায় নির্ধারিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইন্টারনেট খাতের বিশেষজ্ঞদের একটি সম্মেলন শ্রীলঙ্কায় সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশিদের উদ্বেগের কারণে অর্থ পাচার সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও বাতিল হয়েছে। সম্মেলনটি হওয়ার কথা ছিল এ মাসের শেষ সপ্তাহে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, জাপান কি বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ কমিয়ে দেবে? তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা কি বাংলাদেশে না এসে অন্য কোনো দেশে যাবে?

লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist