বিবিসি
অর্থ পাচার রোধ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
সুইটজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশটির ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় বিশ শতাংশ বেড়েছে। এই অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস বা সেকেন্ড হোম নির্মাণ কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণের তালিকায় বাংলাদেশিরা তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার রোধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। এসব খবরে অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
ঢাকায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন, গত কয়েকবছরে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে গেছে, তার একটা ছোট অংশ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন,
‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটিসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে রিপোর্ট যা পাচ্ছি, তাতে দেখছি, আট নয় বিলিয়ন ডলার গত কয়েকবছর ধরে যাচ্ছে। এছাড়া মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ যাচ্ছে।’
এরআগে ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআই বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ পাচারের অভিযোগকে আমলে নিতেই রাজি নন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। কয়েকদিন আগে সংসদে তিনি বলেছেন, অর্থ পাচারের বিষয়টি নজরে নেয়ার মতো নয়। তিনি বলেন, ‘টাকা পাচারের বিষয়টি বাস্তবে তেমন কিছু নয়। সুইস ব্যাংকের যে হিসাব কাগজে বেরিয়েছে, এগুলো হলো লেনদেনের হিসাব। হ্যাঁ, সত্যিই কিছু পাচার হয়। সেটা যৎসামান্য।’
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থপাচার রোধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থার কর্মকান্ড সমন্বয় করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সুইস ব্যাংকের প্রকাশিত হিসাব পর্যালোচনা করেছে। সেই পর্যালোচনার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহাও বলছেন, অর্থ পাচারের পরিমাণ খুব বেশি নয়।
এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে দাম কম বেশি দেখিয়েই মূলত অর্থ পাচার করা হয়। মোস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন, আমদানির রপ্তানির সময় দাম গোপন করে অর্থ পাচারের বিষয়টিই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
‘শতকরা ৮০ভাগই যাচ্ছে, আমদানি-রপ্তানির সময়। আমদানি মূল্যটাকে বেশি করে দেখানো হচ্ছে। আবার রপ্তানির ক্ষেত্রে মূল্য কম করে দেখানো হচ্ছে। এর মাধ্যমেই বড় অংকের টাকা চলে যাচ্ছে।’
আমদানি রপ্তানির সময় পণ্যের দাম গোপন করার অভিযোগ অযৌক্তিক বলেই উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘আমি এর সাথে একমত নই। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়া কোনো কম্যুনিটিকে অর্থ্যৎ ব্যবসায়ী, রাজনীতিক বা আমলা, কাউকেই অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং সম্পর্কে কারও কনসেপ্ট পরিস্কার নয়। যেমন আমেরিকাতে আমাদের যদি অ্যাপারেল যায়, এই যাওয়ার ক্ষেত্রে শতকরা ১৫ থেকে ৩৪ ভাগ পর্যন্ত কর দিতে হয়। এখন বৈধভাবেই যদি কেউ এই ট্যাক্স কমাতে পারে। সেটা কি খারপ কিছু হলো?’
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী কয়েক বছর ধরে সুইস ব্যাংক শুধু জমাকৃত অর্থের পরিমাণটা প্রকাশ করছে। এখনকার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তথ্য দেয়ার ব্যাপারে ওই ব্যাংকগুলোর উপর চাপ বাড়ছে বলে মনে করেন দুর্নীতি বিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন আন্তর্জাতিক আইনী কাঠামোর কারনে যে দেশে অর্থ যাচ্ছে, তারা অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করছে। এছাড়া জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের কারনে দেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান প্রদানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী যে সনদ আছে, এর বাইরে বাংলাদেশ অর্থ সরবরাহের তথ্য জানার জন্য ৫১টি দেশের সাথে দ্বিপক্ষিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এরমধ্যে মালয়েশিয়ার সাথে এই সমঝোতা থাকায় দেশটিতে সেকেন্ড হোম নির্মাণকারি বাংলাদেশিদের অনেকের তথ্য আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শুভংকর সাহা বলছিলেন, সুইটজারল্যান্ডের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক না থাকায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তারা তথ্য দেয় না।
‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সুইস ব্যাংক ঢালাওভাবে তথ্য দেয় না। তবে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বাংলাদেশিদের অর্থ নেয়ার কিছু অভিযোগ পেয়েছিলাম। সেগুলোর ব্যাপারে আমরা মালয়েশিয়া থেকে তথ্য এনেছি। সেই তথ্যে পাওয়া গেছে যে, কেউ কেউ এখান থেকে নিয়ম ভেঙ্গে অর্থ পাচার করেছে। তাদের ব্যাপারে এখন দুদক তদন্ত করছে।’
দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের সচিব আবু মো: মোস্তফা কামালের এব্যাপারে বক্তব্য হচ্ছে, অর্থপাচার প্রতিরোধ সম্পর্কিত এখনকার আইনে তাদের কর্মপরিধি সীমিত করা হয়েছে এবং সেই সীমানার মধ্যেই তারা কাজ করছেন।
"