মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তি

পেট্রাপোলে পণ্য পরীক্ষণের সিদ্ধান্ত স্থগিত

বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানি-রফতানি পণ্য চালান খালাস হওয়ার আগে আনলোড করে শতভাগ পরীক্ষণের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা আপাতত স্থগিত করেছেন ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পেট্রাপোল বন্দরে পর্যাপ্ত জনবল, জায়গা ও পণ্য ওঠানামানোর যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা না থাকায় পেট্রাপোল কাস্টমস এমন সিদ্ধান্ত স্থগিত করে বলে জানা গেছে। তবে এতে ব্যবসায়ীরা সাময়িকভাবে খুশি হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না। হঠাৎ করে কবে আবার এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তারা সেই অপেক্ষায়।

আমদানিকারক ও বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় এমনিতেই একটি পণ্য চালান ভারত থেকে আমদানি করতে ৫ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত লাগে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া পেট্রাপোল বন্দরে আবার প্রতিটি পণ্য চালান আনলোড করে শতভাগ পরীক্ষা করতে গেলে ভোগান্তি আরো কয়েক গুণ বেড়ে যেত। এর ফলে পণ্য খালাস একদিকে যেমন কঠিন হয়ে পড়ত, তেমনি আমদানি খরচও বেড়ে যেত। যার প্রভাব পড়ত দেশীয় বাজারে। আর ব্যবসায়ীরা এই বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত স্থগিতে বাণিজ্যে আবার গতি ফিরবে বলে তাদের ধারণা। সূত্র জানায়, গত ১৬ এপ্রিল ভারতের পেট্রাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেখানকার আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় আমদানি-রফতানি পণ্য চালান খালাসের আগে পেট্রাপোল বন্দরে শতভাগ পরীক্ষা করতে হবে। যার স্মারক নম্বর ১১(২৬)১১৩/পিটিপিএল-আরডি/আইএমপি/এমআইএসসি/২০১৮-১৯/২৭২৫। এতে পরের দিনে ভারত থেকে বেনাপোল বন্দরে পণ্য চালান প্রবেশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। টনক নড়ে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের।

পরে ২০ এপ্রিল (শনিবার) বিকেলে ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে আপাতত শতভাগ পরীক্ষণের নির্দেশনা স্থগিত ঘোষণা করেন। এরপর গত ২১ এপ্রিল সকাল থেকে আগের নিয়মে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শুরু হয়। ওপারের সিএন্ডএফ এজেন্টসসহ বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে।

বেনাপোল আমদানি-রফতানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক জানান, আমদানি-রফতানি পণ্যের শতভাগ পরীক্ষণ বন্ধের সিদ্ধান্ত অস্থায়ী। সেটা যেকোনো সময় আবার কার্যকর হতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে পরে ব্যবসায়ীরা আবার একই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

ভারতের পেট্রাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী জানান, বাংলাদেশের মতো পণ্য রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা পেট্রাপোল বন্দরে নেই। ফলে এমনিতেই সেখানে সারা বছর পণ্যজট লেগেই থাকে। মালামাল আমদানি-রফতানিতে মারাত্মক সমস্যা হয়। এখানকার ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীরা শতভাগ পণ্য পরীক্ষার বিষয়টি কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হলে তারা আপাতত সিদ্ধান্ত স্থগিত করে আগের নিয়মে পণ্য খালাস সচল রেখেছেন।

বেনাপোল কাস্টমসের সহকারী কমিশনার আকরাম হোসেন জানান, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জেনেছি পেট্রাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আপাতত আমদানি-রফতানি পণ্যের শতভাগ পরীক্ষণ স্থগিত করেছেন। আগের নিয়মেই পণ্য আমদানি-রফতানি হচ্ছে। তবে বিষয়টি ঝুলিয়ে না রেখে দ্রুত সমাধান করা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

জানা যায়, দেশে ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩ বন্দরের অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। ১৯৭২ সাল থেকে এ পথে ভারতের সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্যিক যাত্রা। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে প্রতি বছর ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে থাকে। প্রতি বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে অনেক আগে থেকেই বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বন্দরে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশাসনিক বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা আর ব্যবসায়ী হয়রানির কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে কাঙ্খিত রাজস্ব আসছে না।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত বছর বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল ১৫২ দিন। এর মধ্যে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাস্টমসের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির দ্বন্দ্ব, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলন আর বন্দরে অগ্নিকা-ের ঘটনায় বাণিজ্য বন্ধ ছিল ২৬ দিন এবং সরকারি ছুটিতে বন্ধ ছিল ১২৬ দিন। তবে সাপ্তাহিক ছুটিতে শনিবার আমদানি-রফতানি সচল থাকলেও বন্দরের অধিকাংশ কর্মকর্তারা অনুপস্থিত, অভারটাইম আদায় এবং বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো নগদ অর্থে লেনদেন না করায় ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে চাহিদামতো পণ্য খালাস নিতে পারেনি। এতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় সরকারের ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। আর ব্যবসায়ীদের লোকশান হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। জুলাই-১৮ থেকে গত ৭ এপ্রিল পর্যন্ত গত ৯ মাস ৭ দিনে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ২২৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এ সময় আদায় হয়েছে ৩ হাজার ১০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ১১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। গেল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ সময় ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close