প্রিন্স রাসেল

  ০১ জানুয়ারি, ২০১৮

ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতি : পেশাদারিত্বের সংকট

মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ। ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে গেল আরো একটি বছর। হারিয়ে যাওয়া বছরের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসছে সাফল্য ও ব্যর্থতার অনেক চিত্র। চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত মাঠের ফলাফল প্রায়ই আড়াল করে দিচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং লাগামছাড়া খামখেয়ালিপনা। যেটার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন খেলোয়াড়রা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। নষ্ট হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। যেটা হয়তো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু সার্বিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই নেতিবাচক ইস্যুগুলো। পুরোনো বছর যায়, আসে নতুন বছর। কিন্তু চিরায়িত হয়ে ওঠা দৃশ্যগুলো আর বদলায় না। প্রতিনিয়ত হচ্ছে পুনরাবৃত্তি।

নবাগত বছর আশার যে ফুল ফোটায় সেটা পঞ্জিকার শেষ দিনে জরাজীর্ণতায় রূপান্তর হয়ে বিষাদের ছাপ রেখে যায়। হতাশার চিত্রটা ঘূর্ণায়মান হচ্ছে বছরের পর বছর। এটা প্রায় নিয়ম হয়ে উঠেছে। তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন সংশ্লিষ্টরা। তাতে নাভিশ্বাস ওঠে খেলোয়াড়দের। তারা শোষিত হওয়ায় ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে খোদ ক্রীড়া সংস্থাগুলোই। বিকশিত হচ্ছে না প্রতিভা। পুরো বছরের সার্বিক বিষয়াদি কাটাছেঁড়ার পর কাঠগড়ায় চলে আসছেন সংগঠকরা। যেটার কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষমতার চেয়ার এবং এটার অপব্যবহার হচ্ছে নিয়মিতই। সদ্য বিদায়ী সালও ধারাটা বদলে দিতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে অংশগ্রহণই বড় কথা। এই তত্ত্বটার ওপর দাঁড়িয়ে অনেক সময় যোগ্য ক্রীড়াবিদকেও পাঠানো হয় না প্রতিযোগিতার মঞ্চে। পছন্দসই খেলোয়াড়দের অগ্রাধিকার দেন কোচ, ফেডারেশন কর্তারা। এর সঙ্গে ক্রীড়া বহরের সদস্যরূপে তাদের বিদেশ ভ্রমণটাও হয়। মাঝে মধ্যে যাত্রায় সঙ্গী হন পরিবারের লোকেরাও। অনেক সময় খেলোয়াড়ের চেয়ে সংগঠক, অফিসিয়াল, কোচদের সংখ্যাটা বেশিই দেখা যায়। পরিণামÑপ্রত্যাশিত ফলটা স্বপ্নই থেকে যায়। উপযুক্ত পেশাদারিত্বের অভাববোধটা তাতে স্পষ্ট।

দেশের ক্রীড়া সংস্থাগুলোর এমন অপেশাদার মনোভাবের কারণটাও অনুমেয়। প্রায় সব ক্রীড়া সংগঠনেই রয়েছে রাজনীতির কালো ছায়া। বিশেষ করে সরকার দলীয়দেরই প্রভাব থাকে এখানে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের চেয়ারগুলোতে আধিষ্ট নন ক্রীড়া-সংশ্লিষ্টরা। যারা ওইসব আসন পাততে পারলে হয়তো তাদের পেশাদার ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে পারতেন। খেলোয়াড় যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটাও হতে পারত স্বচ্ছ। থাকত না পর্যবেক্ষণে বড় কোনো ঘাটতিও।

এই ঘাটতিটাই হাওয়ায় মিলিয়ে দিচ্ছে প্রতিভা। বড় মঞ্চে একবার অংশ নেওয়া খেলোয়াড়রা দ্বিতীয়বার অভিজ্ঞতার মূল্য বোঝানোর সুযোগ খুব একটা পাচ্ছেন না। অলিম্পিক, কমনওয়েলথ, এশিয়ান কিংবা দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের মতো বড় আসরে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করাদের পরে খুঁজতে হয় আতশি কাচ দিয়ে। সাঁতারু সোনিয়া আক্তার, তীরন্দাজ শ্যামলী রায়, মাবিয়া আক্তার সীমান্তরা যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছেন উপযুক্ত পর্যবেক্ষণের অভাবে। কেন তারা নিজেদের ছাড়িয়ে যেতে পারছেন না সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ করার মতো সময়ও নেই অভিভাবকদের।

উত্থান-পতন ক্যারিয়ারেরই অংশ। খেলোয়াড়দেরও বাজে সময় আসতে পারে। সময়টা আরো রূঢ় হয়ে ওঠে যখন তাদের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকেন না। উল্টো কোচ কিংবা সংগঠকদের তোপের শিকার হন তারা। এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে। বছর যায়, বছর আসে, উদাহরণ বাড়তেই থাকে। বৃদ্ধির যে হার তাতে লাগাম টেনে ধরাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। নবাগত বছরে পাল্টাবে তো দৃশ্যপট? উত্তরটা তোলা থাকল ভবিষ্যতের জন্য।

এমনিতেই বাজেটে ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দটা সীমিত। সেটাও অবশ্য নেহাত কম নয়। তবু স্বল্প আয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারই তো কাম্য। সদিচ্ছা থাকলে সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত টাকা দিয়েই ফেডারেশন, স্থাপনা ও খেলোয়াড়দের মানোন্নয়ন করা যেতে পারে। কিন্তু নিরাশ হতে হয় তখন, যখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সংগঠক ও সংশ্লিষ্টদের পকেট ভারি করাটা লক্ষ্যে পরিণত হয়ে থাকে। বছরে বছরে ফুলে-ফেঁপে উঠছে তাদের পকেট। পুকুরচুরি করে তাদের আঙুল ফুলে হচ্ছে কলাগাছ।

সরকারের দেওয়া বরাদ্দের বাইরেও ক্রীড়া সংস্থাগুলোর আয়ের অনেক উৎস আছে। যেটার বড় একটা অংশ আসে পৃষ্ঠপোষণা থেকে। সেটার চুক্তি কিংবা অর্থের অঙ্ক, ব্যবহারের খাত এসব কিছু গোপন রাখা হচ্ছে। পরে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপও বেরিয়ে আসছে। তাতেও কিছু আসে-যায় না। এসব কিছু থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। বরং দুর্নীতিকে আদর্শ হিসেবে ধারণ করে নির্লজ্জের মতো ক্রীড়াঙ্গনের সর্বনাশ করছে ওইসব অসাধু ব্যক্তি। এই মতাদর্শ থেকে নতুন বছরে বেরিয়ে আসতে পারবে ক্ষমতাধররা?

বিদায়ী বছরটা দু’হাত ভরে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। প্রথমবারের মতো আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টের (চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) সেমিফাইনালে উঠেছে টাইগাররা, দীর্ঘ পরিসরের ফরম্যাটে হারিয়েছে ক্রিকেটের বনেদি দল অস্ট্রেলিয়াকে, শ্রীলঙ্কার মাটি বাংলাদেশ জয় করেছে ঐতিহাসিক শততম টেস্টে, সরাসরি উঠেছে বিশ্বকাপের মূল পর্বে। এসব সুখময় স্মৃতির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে নানা বিতর্ক। পাঁচ দিনের ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিমের হাত থেকে গ্লাভস কেড়ে নিয়ে সীমানা দড়িতে ফিল্ডিং করানো, পরে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া, চন্ডিকা হাথুরুসিংহের স্বেচ্ছাচারিতা ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই পদত্যাগ করা এবং সবশেষ ক্রিকেট বোর্ডের আদালতের চৌকাঠ মাড়ানো।

দেশের সবচেয়ে সফল ক্রীড়া সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেও (বিসিবি) চেয়ার একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল গেল বছর। এখানেও বোর্ডের নীতিনির্ধারক রাজনৈতিক লোকেরা। বছরের শেষ দিকে জাতীয় দল যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় নাকানি-চুবানি খাচ্ছিল সেটা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না তাদের, তাছাড়া জবাবদিহিতার কোনো ব্যাপারও তো নেই। তাই চেয়ার ধরে রাখার লড়াইয়েই ব্যস্ত ছিলেন তারা। একটা পর্যায়ে তো ক্রিকেট বোর্ডকে রাজনৈতিক কোনো দলের কার্যালয় বলেও মনে হচ্ছিল। পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছিল ‘হোম অব ক্রিকেট’ খ্যাত মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম।

অবশ্য গেল বছর মিরপুরের মতো লোকে লোকারণ্য ছিল না অন্য ফেডারেশনগুলো। তবে চেয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি ছিল। যেটার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন। পদ টিকিয়ে রাখতেই দৌড়ঝাঁপ ছিল সংগঠকদের। তাতে গোল্লায় গেছে ২০১৭ সালের ঘরোয়া হকি লিগ, টুর্নামেন্ট ও খেলোয়াড়দের দলবদল। এই হতাশার আঁধারে আলোর রেখা হয়ে থাকল বত্রিশ বছর পর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ হকি। এই টুর্নামেন্ট দিয়েই মওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম পেয়েছে ফ্লাড লাইটের আলো। কিন্তু তৃপ্তির ঢেঁকুর পুরোপুরি না উঠতেই হারাতে হয়েছে হকির সূর্যসন্তান খাজা রহমতউল্লাহকে। তৎকালীন সহ-সম্পাদক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদকও জীবিতাবস্থায় প্রভাব ধরে রাখার কম কৌশল দেখাননি।

হকি ছাড়াও এ বছর ঢাকায় আরো কয়েকটি টুর্নামেন্ট হয়েছে। প্রথমবারের মতো এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চ হয়েছে বাংলাদেশ, রোলবল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে রোলার স্কেটিং ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক ভলিবল টুর্নামেন্ট এবং সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। সবশেষ আসরটিতে সর্বোচ্চ সফলতা পেয়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। অদম্য কিশোরীদের এই সাফল্য কিছুটা হলেও আড়াল করেছে বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ব্যর্থতাটা।

বাফুফে নির্বাচনের আগে নির্বাচিত প্রার্থীরা কথার যে ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন সেটার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া গেল না। সরেজমিনে দেখা মিলল পুরোনো সেই চিত্রের। তিন বছরের জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসিত হওয়া বাংলাদেশের যেভাবে প্রত্যাবর্তন করা জরুরি সেই ফেরার লড়াইটাও প্রায় অদৃশ্যমান। পাইপলাইন সমৃদ্ধিতে প্রতিভা অন্বেষণের প্রক্রিয়াটাও ঠিক চোখে পড়ার মতো নয়।

জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরিতে ঘরোয়া ফুটবল টুর্নামেন্টের বিকল্প নেই। এখানেও হতাশাটা স্পষ্ট। শেষ হওয়া বছরে দেশের ফুটবলের সবচেয়ে নিরাশ হওয়ার মতো বিষয় গ্যালারির দৈন্যদশা। ঢাকার বৃত্তে লিগ ও খেলা আটকে রাখায় ফুটবলের প্রত্যাশিত জাগরণটাও হচ্ছে না, বছরজুড়ে খেলোয়াড়রা দেখেছেন খাঁ খাঁ গ্যালারি। অথচ সমর্থকরাই তো যেকোনো খেলার মেরুদ-। তাহলে ফাঁকা স্টেডিয়াম চত্বর কীভাবে ফুটবলারদের অনুপ্রাণিত করবে!

ঢাকার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলে ফুটবল যে জাগরণ তুলতে সক্ষম সেটার প্রমাণ মিলেছে। জন¯্রােত দেখা গেছে যশোর, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহের মতো জেলাগুলোতে। তবু মৃত প্রায় ফুটবলের পুনর্জন্মের বিষয়ে উদাসীন মনোভাব সংগঠকদের। অজুহাত হিসেবে নানা রকমের সীমাবদ্ধতা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরছেন তারা। তাই বলে দর্শক মাঠে টানতে না পারার দায়টা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না বাফুফের চেয়ারধারীরা।

দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার দায়ে কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হবে এসব সংগঠককে। শৃঙ্খলা-বেড়ি পরতে হবে নিজেদের, পরাতে হবে অধীনস্থ ক্লাবগুলোকেও। পেশাদার হতে হবে আবাহনী, মোহামেডান, শেখ জামাল, শেখ রাসেলের মতো বড় ক্লাবগুলোকে। যাদের আদর্শ মেনে পথ চলবে অন্যরাও। না হলে ফিফা-এএফসির কাছে বিদেশি কোচ-খেলোয়াড়দের নালিশ চলতেই থাকবে, হেয় হতে থাকবে বাংলাদেশের ফুটবল।

ফুটবল তো বটেই, দেশের গোটা ক্রীড়াঙ্গন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করুক, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির মতো দুষ্টচক্র থেকে ক্রীড়া অভিভাবকরা বেরিয়ে আসুক এটাই তো প্রত্যাশা ষোলো কোটি মানুষের। এগিয়ে যাক লাল-সবুজের ক্রীড়াঙ্গন। বদলে যাওয়ার শুরুটা হোক না নতুন বছর দিয়েই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist