তানভির মেহরাজ

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৭

বই আলোচনা

একাত্তরের ভোর

ভালোবাসার এই পৃথিবীতে শাশ্বত সম্পর্কের মাঝে বাধার দেয়াল তৈরি হয়েছে চিরকাল। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কিংবা হিংসার রূপ এসে দাঁড়িয়েছে প্রতিবন্ধক হয়ে। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা যে অমর। তাইতো শত আঘাত, দুঃখ, বেদনা, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা বারবার মাথানত করেছে এই প্রেমের পদযুগলে। ভালোবাসা নিজেই জয়ধ্বনি দিয়েছে ইতিহাসের সেই প্রেমিকদের যারা বিরহের মালা গলায় জড়িয়ে প্রিয় মুখটির জন্য

অপেক্ষায় থেকেছে।

‘একাত্তরের ভোর’ কবি ও কথাশিল্পী আবু জাফর খানের নিপুণ হাতে সুতোয় গাঁথা হাজারো প্রতিকূলতার বৃত্তে বন্দি তেমনি একটি সফল প্রেমের উপন্যাস। ১৯৭১ সালের ক্রান্তিলগ্নে দুটি কোমল হৃদয়ের আলিঙ্গনকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বইয়ের পাতায়

বন্দি করেছেন তিনি।

সোমেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে ওঠা সবুজ-শ্যামল শমপুর গ্রামের খান পরিবারের ছেলে রুদ্র শাওন। একটু চুপচাপ স্বভাবের শাওন পড়ালেখায় বেশ পাকা। স্কুলে আশা যাওয়া কিংবা গল্পের ছুতোয় দিনের অনেকটা সময় তার কাটে যমুনার তীরের শ্রী নিবাজদিয়া গ্রামের মুখুজ্জে পরিবারের শিপ্রার সঙ্গে। হরনাথ বাবুর মেয়ে শিপ্রা পড়ালেখায় শাওনের দু’ক্লাস সিনিয়র হলেও তাদের আত্মার সম্পর্ক বড়ই গভীর। শিপ্রাদি বলতেই শাওনের মনের গহিনে যেন একঝাঁক তারা ঝলমল সোনালি আকাশ, সে জগতে কেবল তারাই মানব-মানবী। তারা দুজন হয়ে ওঠে একে-অপরের পরিপূরক। কিন্তু জীবনের বয়ে চলা রঙিন পথে হঠাৎই হানা দেয় কালো মেঘের ছায়া।

১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণে শ্মশান ঘাটে পরিণত হয় সবুজের সমারোহ বাংলার জনপদ। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষ ছুটতে থাকে দিগি¦দিক। হাজারো উদ্বাস্তুর ঢল নামে খান বাড়ির আঙিনায়। নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে শিপ্রার পরিবার আশ্রয় নেয় খান বাড়িতে। বাঙালি জাতির একাত্তরের সেই দুর্দিনের চিত্র কাগজে মুড়িয়ে তুলে ধরেছেন লেখক। সেই সময়ের পাকিস্তানি হানাদার ও তার দোসরদের করা নির্মমতার কিছু অংশ তিনি তুলে আনার চেষ্টা করেছেন এই উপন্যাসে।

ঘটনার পালা বদলে পাকিস্তানি দোসরদের দৃষ্টি পড়ে রূপবতী শিপ্রার ওপর। মানবরূপী নরপশুদের ছোবল থেকে সম্ভ্রম রক্ষায় হরনাথ বাবুর পরিবার একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রওনা হয় ভারতের উদ্দেশে। ১৪ আগস্টের সেই একাত্তরের ভোর শাওনের জীবনকে নিক্ষেপ করে অন্ধকারাচ্ছন্ন মরুময় এক বিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে। তার প্রিয় মানুষটিকে নিজ জন্মভূমি, আপন গ্রাম, চেনা মানুষদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে কোনো এক ভিনদেশি সেনাদের ঔদ্ধত্যের কারণে!

১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই দিনগুলোতে কত শত পরিবারকে এভাবেই ত্যাগ করতে হয়েছে নিজের বাসভূমি, চেনা আকাশ, শাপলা ভরা জল থইথই বিল, জীবনানন্দে সাঁতার কাটা সেই চেনা বকুল তলার পুকুর। উপন্যাসটি একাত্তরের দালিলিক কোনো ভিত্তি না হলেও সেই সময়ে ঘটে যাওয়া পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যা, দমন, নিপীড়ন, লুণ্ঠনের কথা উঠে এসেছে গল্পের প্রয়োজনেই। এভাবেই হয়তো লেখক আমাদের জানাতে চেয়েছেন বাস্তুহারা মানুষের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প।

এদিকে আপন ভূমি, চেনা প্রকৃতি, প্রিয় মানুষদের ছেড়ে যাওয়া শিপ্রাও ভেঙে পড়ে নিজের মধ্যে। নিজ বাসভূমে আবার ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকে না। মেধাবী শিপ্রা ভর্তির সুযোগ পায় কলকাতার নামকরা প্রেসিডেন্সি কলেজে। এত কিছুর মাঝেও কর্মব্যস্ত কলকাতায় ঠাঁই হয় শিপ্রার কেবল আবেগ-উচ্ছ্বাসহীন নিথর দেহের!

পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে আলোর মুখ দেখতে শুরু করে মুক্তিকামী বাঙালি সেনারা। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালিদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে। পৃথিবীর মানচিত্রে খোদাই করা হয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ। কিন্তু শাওনের হৃদয় মানচিত্র রয়ে যায় আগেকার মতই চূর্ণ-বিচূর্ণ। দেশ স্বাধীন হলেও শিপ্রাদির আর ফিরে আসা হয় না আপন দেশে। পড়াশোনা শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজেই লেকচারার হিসেবে যোগ দেয় শিপ্রা। এইতো মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন! সময়ের প্রয়োজনে নিজেকে দাঁড় করাতে হয় নিজেরই বিপরীতে। মনের সুন্দর সাজানো কল্পনাগুলোকে সুচতুরভাবে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হয় জীবনের তাগিদে।

আর শাওন তার বাবার ইচ্ছায় ডাক্তারি পাস করে গ্রামে ফিরে আসে অসহায় মানুষদের সেবা করার লক্ষ্যে, যা ছিল মূলত তার শিপ্রাদির ছোট বেলার স্বপ্ন। শাওন তার হৃদয়ের মানুষকে হারিয়ে তার জমানো স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্য দিন-রাত এক করে দেয় রোগীদের চিকিৎসায়। কিন্তু ভালোবাসা তো পরাজিত হওয়ার নয়। হাজারো প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে একদিন ঠিক খুঁজে নেয় তার বর্ণিল আবাস ভূমিকে। মানুষ ফিরে পায়

জীবনের মানে।

‘একাত্তরের ভোর’ উনিশ শ একাত্তরের পটভূমিকে উপজীব্য করে রচিত হলেও লেখক আবু জাফর খান বইটিতে ভালোবাসা-বিরহের খুব পাশে মানুষের রহস্যময় অন্তঃভাবনা, যুদ্ধ যন্ত্রণা, স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। চরিত্রগুলোর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন জীবনের উচ্ছ্বাস, হাহাকার, দুঃখ-বেদনা, প্রেমাকুলতা, মমতা ভালোবাসার গভীরতম জগতের সন্ধান। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন উপমা ব্যবহারে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনায় পাড়ি দিয়েছেন উপমার সব নদী, যা উপন্যাসটিকে করেছে আরো বেশি প্রাকৃতিক, জীবন্ত

এবং প্রাণবন্ত।

লেখক

আবু জাফর খান

প্রকাশক

ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ

মূল্য

২০০ টাকা

প্রচ্ছদ

আদিত্য অন্তর

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist