মাসুমা রুমা

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৭

অচেনা মেয়েটি

‘আপনার কাছে পানি হবে?’ -চন্দনার পাশের মেয়েটি জানতে চাইলো। কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে দেয় চন্দনা। দুজনকে সমবয়সী বলে মনে হয়। উভয়ের মুখের লাবণ্য, উচ্চতা, শারীরিক গঠনে যথেষ্ট মিল আছে। প্রচন্ড গরম পড়েছে। আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেই বোঝা যায়- রোদ কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। গরমকে উসকে দিতে ট্রাফিক জ্যাম তো আছেই। জ্যামে পড়লে চন্দনা বই পড়ে। গল্প বা উপন্যাসই বেশি পড়া হয়। বাসে বসে কবিতা তেমন পড়া হয় না। চন্দনা উচ্চস্বরে কবিতা পড়তে ভালোবাসে। বাসের ভেতরকার পরিবেশের সঙ্গে যেটা একদমই বেমানান। তাই যাত্রাপথে সঙ্গে কবিতার বই রাখে না চন্দনা। ব্যাগ থেকে একটি গল্পের বই বের করে পড়তে শুরু করলে, মেয়েটি আবারও প্রশ্ন করে বসে।

‘আপনি কি লেখক?’ আচমকা এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে চন্দনা কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে। চন্দনা লিখতে ভালোবাসে। মন চাইলেই লিখতে বসে। যা লিখতে ভালো লাগে তাই লেখে সে। মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করাকে সে অন্যায় মনে করে। অনেকগুলো গল্প জমা হয়েছে তার। দু’চারটি উপন্যাসও আছে। মাঝে মাঝে কবিতাও যে লেখে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু তাই বলে নিজেকে লেখক দাবি করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, চন্দনা ভেবে পায় না। প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চন্দনা নিজেই পাল্টা প্রশ্ন করে বসে-‘আপনি যাবেন কোথায়?’ মেয়েটি কোমল কণ্ঠে বলে- ‘জানি না।’ এরপর বেশ কিছুটা সময় তারা কেউ কোনো কথা বলেনি। পিনপতন নীরবতা!

জ্যাম শেষ হলে বাস উত্তরা হয়ে আবার চলতে শুরু করে। যাত্রাপথে চুপচাপ বসে থাকা চন্দনার অপছন্দ। আগ বাড়িয়ে কথা বলাটাকেও অভদ্রতা মনে হয় তার। তবু সে মেয়েটিকে বলল-‘আপনি কি কোনো সমস্যায় পড়েছেন?’

মেয়েটি চুপচাপ। কোনো উত্তর দিল না। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করল কি না সন্দেহ। মেয়েটির প্রতি চন্দনার কৌতূহল বাড়তে শুরু করল।

তাই সে আবারও বলল- ‘আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছি? আসলে চুপচাপ থাকতে ভালো লাগছে না। আপনি যদি একটু গল্প করতেন সময়টা ভালো কাটত।’

মেয়েটি এবার জানালা থেকে চোখ সরিয়ে চন্দনার মুখে দিকে চাইল। মেয়েটির চোখ দেখে মনে হলো, পৃথিবীর সব উদাসীনতা তার দু’চোখে মেঘের মতো জমে আছে। একটু পরেই হয়তো মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। হয়তো চন্দনাও ভিজে যাবে সে বৃষ্টিতে।

‘কী গল্প শুনবেন? আমার জীবনে বলার মতো কোনো গল্প নেই।’

‘যা আছে তাই বলুন না। আপনার মনটা এতে হালকা হতে পারে। শুনেছি, সুখের কথা বললে সুখ দ্বিগুণ হয়ে যায়, কষ্টের কথা বললে কষ্ট অর্ধেক হয়ে যায়।’

‘বাহ্! আপনি তো খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। কলেজে আমার একটা বান্ধবী ছিল, সেও আপনার মতো গুছিয়ে কথা বলত।’

‘আপনি কি কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন? আমি কিন্তু গল্প শোনার অপেক্ষায় আছি।’

‘ঠিক আছে। শুনুন তাহলে আমার জীবনের গল্প। বাবাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। তার মুখের ওপর কোনো কিছুই বলতে পারি না। একদিন রাতের খাবার শেষে, বাবা আমাকে তার রুমে ডাকলেন। আমি ভেবেছিলাম কোনো অনাকাক্সিক্ষত ভুলের জন্য বাবা হয়তো বকবেন। কিন্তু তিনি আমাকে অবাক করে জানালেন, আমার জন্য ভালো একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। আমার আপত্তি না থাকলে তিনি বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। আমি কিছু বলতে পারিনি। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম শুধু। মায়ের কাছে জানলাম, আমার হবু স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো। ’

‘তারপর...’

‘পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়েটা হলো। বিয়ের পর পরই আমার স্বামী একটা বাসা ভাড়া করে আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলো। ঢাকায় আগে এসেছিলাম কয়েকবার, তবে দীর্ঘদিন থাকা হয়নি। তাই নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সমস্যা হলো। তবে বেশ ভালো সময় কাটছিল আমাদের। ছুটির দিনগুলোতে আমরা ঘুরতে যেতাম। ঘাসের ওপর হাত ধরে হাঁটতাম দুজন।’

‘বাহ্! দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

‘হুম....ভালোবাসি। বিয়ের তিন বছরের মাথায় ওর চাকরিটা চলে গেল। কারণ জানতে চেয়েছিলাম, ও বলেনি। মেয়েদের নাকি সবকিছু জানতে নেই। আমিও আর আগ্রহ দেখাইনি।’

‘তারপর কী হলো?’

‘চাকরিটা চলে যাওয়ায় সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হলো। উপায় না দেখে আমি একটা স্কুলে চাকরি নিলাম। সেটা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চলছিল। বাবার কাছ থেকেও কিছু টাকা এনেছিলাম।’

‘এরপর কী হলো?’

‘ওর জন্য রান্না করে দিয়ে আমি রোজ স্কুলে চলে যেতাম। ফিরতাম সেই বিকেলে। বাড়ি ফিরে দেখতাম সে রুমেই বসে আছে। ওর জন্য আমার খুব খারাপ লাগত। ভাবতাম, চাকরি নেই বলে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে হয়তো লজ্জা পায়। তবে দিনভর বাসাতে পড়ে থাকাটা আমার একদম ভালো লাগত না।’

‘কেন ভালো লাগত না?’

‘প্রায়ই সন্দেহজনক অনেক কিছু চোখে পড়ত।’

‘কী রকম সেটা?’

‘একদিন ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে দেখি, বিছানার পাশে একটা পাথরের দুল পড়ে আছে। দুলটা আমার ছিল না।’

‘তাহলো দুলটা কার ছিল?’

‘সেটা জানলাম প্রায় এক সপ্তাহ পরে।’

‘কীভাবে জানলেন?’

‘একদিন ওকে বললাম, ঘরে আর কত বসে থাকবে, আজ আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়। আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তুমি না হয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিও। সামান্য এ কথাতেই সে খুব রেগে গেল। আমার সন্দেহটা আরো বেড়ে গেল। আমি তখন মনে মনে একটা বুদ্ধি আঁটলাম।’

‘কেমন বুদ্ধি?’

‘আমি একদিন স্কুলে না গিয়ে পাঁচতলার সিঁড়ির এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ফ্ল্যাট ছিল চারতলাতে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম, চারতলার কেউ আমাকে দেখতে পাবে না, কিন্তু আমি দেখতে পাব কে কে চারতলাতে আসে।’

‘সেদিন কি কেউ এসেছিল?’

‘হুম। একটা মেয়ে। বয়সে প্রায় আমার কাছাকাছি হবে। আমার চেয়ে ছোটও হতে পারে। ওদের কথাবার্তা দেখে মনে হলো, আমি স্কুলে চলে যাওয়ার পর রোজ মেয়েটা আসে।’

‘আপনি তখন কী করলেন?’

‘ওরা ঘরে ঢুকে যাওয়ার একটু পরেই আমি কলিংবেল চাপলাম। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলল আমার স্বামী। আমাকে দেখে সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। জানতে চাইল অসময়ে আমি বাড়িতে কেন। আমি তাকে শরীর খারাপের অজুহাত দিলাম। এরপর অনেক কিছু খোঁজার বাহানাতে আমি মেয়েটাকে খুঁজতে শুরু করলাম। মেয়েটা যে ঘরের মধ্যেই ছিল এ বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম। সে আমার আচরণ দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। যখন আমি ওয়াশরুমে যেতে চাইলাম, সে কিছুতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলতে দিল না। আমি এক রকম জোর করে ওয়াশরুমের দরজা খুললাম। মেয়েটা তখন মাথা নিচু করে বাইরে বেরিয়ে এলো। ওরা বুঝে গিয়েছিল আমি ওদের কিছুতেই ছাড়ব না। আমার স্বামী মেয়েটাকে চোখের ইশারা করতেই, মেয়েটা আমাকে পেছন থেকে শক্ত করে জাপটে ধরল। আমার স্বামীকে তখন ঠিক শয়তান মনে হয়েছিল। বিয়ের পর থেকেই সে আমার সঙ্গে অভিনয় করে আসছে, অথচ বুঝতেই পারিনি কিছু। কতটা বোকা আমি!’

‘তারপর...’

‘তারপর দুজন মিলে আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করল। আমার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল, যেন শব্দ করতে না পারি। ওরা আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল।’

‘আমার গা শিউরে উঠছে। আপনি বেঁচে ফিরলেন কী করে?’

‘ভাগ্যের জোরে হয়তো। আমার স্বামীর একটা দুর্বল দিক হলো, সে চশমা ছাড়া একদমই দেখতে পায় না। ওরা যখন জোর করে আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে গেল, আমি মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে আমার স্বামীর চোখের চশমাটা কেড়ে নিলাম। ওটাকে পায়ের নিচে পিষে ভেঙে ফেললাম। তখন ওর আর কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। এরপর কোনো রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি আমি।’

‘পালিয়ে কোথায় গেলেন?’

‘আমার এক বান্ধবী ঢাকাতেই থাকত। তার বাসাতেই গিয়েছিলাম। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট খুব একটা চিনি না আমি। তাই অনেক কষ্ট হয়েছিল বাসা খুঁজে পেতে। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বান্ধবীকে সব খুলে বললাম। সব শুনে সে চমকে উঠল। পরে বান্ধবীই আমার বাড়ির সবাইকে ঘটনাটা জানাল। আব্বা-আম্মা খুব ভেঙে পড়লেন। তাদের একমাত্র মেয়েকে হত্যার চেষ্টা! তাই তারা আমার স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলেন।’

‘শেষটা কী হলো?’

মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে একটা পত্রিকা বের করল। পত্রিকাটি তুলে দিল চন্দনার হাতে। চন্দনা দেখল, সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা- ‘গৃহবধূকে হত্যার অপচেষ্টায় স্বামী আটক’।

‘ওর সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতেই ঢাকায় এসেছিলাম, যদিও আব্বা আম্মা রাজি ছিলেন না। শুধু এটুকু জানতে, সেদিনের মতো আজও কি তার মুখটা শয়তানের মতোই দেখায়! আমার আজ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। একটুও কষ্ট হচ্ছে না ওর জন্য। যেটুকু কষ্ট হচ্ছে নিজের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য। আমার জন্য কী লড়াইটা না লড়ছেন তারা।’

‘আপনাকে ঠিক কী বলা উচিত আমি জানি না। তবে একজন মানুষ হিসেবে বলব- নতুনভাবে সব শুরু করুন। জীবন তো একটাই। একজন মানুষ দিয়ে জগতের সব মানুষকে বিচার করা ঠিক নয়। হয়তো ভালো কিছু অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য।’

বাস থামল। চন্দনা পৌঁছে গেল তার গন্তব্যে। অচেনা মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে বাস আবারও চলতে শুরু করল। তাদের আর কোনো দিন দেখা হবে কি না তা তারা কেউ জানে না। তবে চন্দনা মনে মনে ঠিক করে ফেলল তার লেখক জীবনের শ্রেষ্ঠ গল্পটি আজ সে লিখবে। আর গল্পটি উৎসর্গ করবে সেই অচেনা মেয়েটিকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist