আমিন ইকবাল

  ১০ নভেম্বর, ২০১৭

হেমন্তের শিশির ও সোনারাঙা ধান

বৈচিত্র্যময় এক রূপের দেশ-বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এখানকার প্রকৃতিজুড়ে ছয় ঋতুর খেলা সত্যিই উপভোগ করার মতো। সারা বছর নবনব রূপের মধ্যে আমাদের বসবাস। কাব্য, ছন্দ, সুর আর রূপের খেলায় কখন যে রং বদলায় রসিক প্রকৃতি-বুঝেই আসে না। এখন শিশির স্নাত সকাল আর সোনারাঙা ধান ভাঙার দিন। দক্ষিণা বাতাসে কাশফুলের দোল শেষে হেমন্তের আয়োজনে মাতোয়ারা গ্রাম-বাংলার মানুষজন। কৃষকের মুখে স্বপ্নজয়ের রাঙাহাসি। কদিন পরই ঘরে ঘরে শুরু হবে পিঠাপুলির ধুম। তত দিনে শীতের আগমন আরো ঘনীভূত হবে।

ষড়ঋতুর হিসেবে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ-হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত ভোর। মাঠ ভরা সোনালি ফসল। হালকা শীতের হাওয়ার দোলায় বন-বনানীর হৃদয়জুড়ে মৃদু কাঁপন। দূর্বাঘাসে, গাছের পাতায়, ঘরের চালে শিশির ঝরিয়ে শীতের সূচনা। খেজুরগাছে গাছিদের কলসি বাঁধার দৃশ্য। সত্যিকার নাতিশীতোষ্ণমন্ডলের মূল পরিচয়টাই যেন বাংলার প্রকৃতিতে মূর্ত হয়ে ওঠে এই ঋতুতে।

হেমন্তের শিশির ঝরা সকাল হয় স্বচ্ছ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে রোদ। মিষ্টিরোদ। দুপুরেও নরম থাকে রোদের শরীর। তেজহীন রোদে কৃষকেরা ধান কাটে। মাঠে শুয়ে থাকা সোনারাঙা ধান। বিকেলের আকাশটা ধোয়ামোছা পরিষ্কার। চারদিকে শুধু নীলের ছড়াছড়ি। নীলাকাশের নিচে ছোপ ছোপ সবুজ মাঠ-ঘাট-গ্রাম আর সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা নদী। বর্ষার উচ্ছল নদীটি নীরবে শুয়ে থাকে হেমন্তে।

হেমন্তে কৃষকের মনে আনন্দের দোল লাগে। হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধানে পাক ধরে। কার্তিকের শেষ দিকে তাই গ্রামের মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। অগ্রহায়ণে সেই কাটা ধান মাড়াই করা হয়। এরপর শুরু হয় নবান্নের আয়োজন। ক্ষীর-পায়েসের সঙ্গে চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় চিতই, পাটিসাপটা, পুলি, কুলসিসহ হরেক রকমের পিঠা। এ সময় গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়। কুটুম আসে। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি পিঠা-পুলি দেওয়া-নেওয়া হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলে পূজার আয়োজন। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করে দেবতাকে খুশি করার চেষ্টা করে।

এ সময় গ্রামে গ্রামে মেলা বসে। ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে মেলায় যায়। মেলায় হরেক রকম মিষ্টি, সন্দেশ, নাড়– পাওয়া যায়। সেখানে ওঠে মাটির বানানো নানা ধরনের খেলনাও। হেমন্তের মেলা কৃষক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়।

এ ঋতুতে ফোটে অনেক ফুল। গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম ইত্যাদি ফুলের ম ম ঘ্রাণে সুরভিত হয় এ দুই মাস। এ সময় লেখক-কবিরাও কাব্যের খাতা মেলে বসেন। লিখে চলেন রূপ-লাবণ্যের অসাধারণ দৃশ্যকল্প। তাইতো বাংলা সাহিত্যে হেমন্ত ঋতু অন্যতম উপজীব্য রূপে বিবেচিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে

জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে

শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার

রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার

স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’

কবির মতে, হেমন্তে সোনালি ফসলে প্রকৃতির আভায় নতুন ছবি ফুটে উঠেছে। সেখানে আছে এক অনাবিল প্রশান্তি। যেখানে জনমানব নেই; নেই কোনো শব্দ, গতি। রয়েছে স্তব্ধতা।

‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় হেমন্তের আগমনী, প্রকৃতি ও স্বভাবের এক চঞ্চল রূপ এঁকেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন-

‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরনির সওগাত?

নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাত।

‘গিন্নি-পাগল’ চালের ফিরনি

তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি

হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।

শিরনি বাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত!...’

এই কবিতায় কবি কেবল হেমন্তের প্রকৃতির ছবিই আঁকেননি, একই সঙ্গে পারিবারিক সংস্কৃতির চিত্রও তুলে ধরেছেন। ফসল ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গে কৃষাণ-কৃষাণির মনে যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় তার বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি আছে নবান্ন উপলক্ষে বাড়ির মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করার চিরায়ত রূপটিও।

ষোলোআনা হেমন্তপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় হেমন্ত, প্রকৃতি আর আত্মমগ্নতা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন-

‘চারদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল

তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল,

প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে

পেঁচা আর ইদুঁরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’

‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতায় লিখেছেন-

‘সেই খানে উঁচু উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে

হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল-রাঙা-

চুপে চুপে ডুবে যায়-জ্যোৎস্নায়।

পিপুলের গাছে বসে পেঁচা শুধু একা

চেয়ে দেখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর

রুপার ডিমের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।’

সহজ ও সরল ভাষায় হেমন্ত এঁকেছেন কবি সুফিয়া কামাল। তিনি বলেছেন-

‘সবুজ পাতার খামের ভেতর

হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে

কোন্ পাথারের ওপার থেকে

আনল ডেকে হেমন্তকে?’

আল মাহমুদের কবিতায় হেমন্ত এসেছে মানুষের প্রেমে-কামে প্রকৃতির সৌন্দর্যে। তার কাছে হেমন্ত এক ধরনের পরিপূর্ণতার নাম। ‘আঘ্রাণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-

‘আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে

আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে।

রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে

আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর

বসায় মর্চের দাগ, লাল কালো

কটু ও কষায়।’

তবে, হেমন্তকে একটি বিশেষ কালের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এই সময়ে মানুষের মনে যে কর্মচাঞ্চল্য ও প্রত্যাশার সম্মিলন ঘটে তাকে চিত্রায়িত করেছেন কবি। ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ বলে মানবপ্রেমের নতুন পথ উন্মোচন করেছেন। ফসল কাটার খবর নিয়ে আসতে চেয়েছেন কৃষকের ঘরে ঘরে। তার কবিতা-

‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি অনেক।

তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিলো ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন

কতকালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে

অই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি

আমি দেখছি, কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে

বকের মতো নিভৃতে মাছ।

এমন অসম্ভব রহস্যপূর্ণ সতর্ক ব্যস্ততা ওদের-

আমাদের পোস্টম্যানগুলির মতো নয় ওরা

যাদের হাত হতে অবিরাম বিলাসী ভালোবাসার চিঠি আমাদের

হারিয়ে যেতে থাকে।’

বর্তমান সময়ে বইয়ের পাতায়, কবিতার খাতায় রূপ লাবণ্যের এতসব চিত্র জ্বলজ্বল ভাসলেও বাস্তবে কিন্তু দৃশ্যপট ভিন্ন। কালের দূরত্ব ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেকটাই পাল্টে গেছে গ্রাম-বাংলার হেমন্তরূপ। তাছাড়া আমরাও ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি প্রকৃতির গভীর সান্নিধ্য থেকে। উপলব্ধির চেতনায়ও এখন আর ধরা পড়ে না প্রকৃতির সুনিবিড় দৃশ্যপটগুলোর তাৎপর্য। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কৃত্রিম হয়ে পড়েছে অপরূপা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শোভা! যা কাম্য নয় কখন-ই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist