আবদুস সালাম

  ১০ নভেম্বর, ২০১৭

ঘৃণা

অনেকের ধারণা দশ গ্রাম খুঁজলেও মিফতির মতো সুন্দরী একটি মেয়ে পাওয়া যাবে না। সে মা-বাবার খুব আদরের সন্তান। তারা তিন ভাই-বোন। মিফতি সবার বড়। পড়াশোনাতেও বেশ ভালো। তার ছোট দুই ভাই প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। বাবা শহরের একটি বেসরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক। বেশখানিকটা পথ পাড়ি দিয়েই মিফতিকে স্কুলে যেতে হয়। স্কুলে যাওয়ার পথটি দু-তিনটা গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। আশপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরাও মিফতিদের স্কুলে পড়তে আসে। উঠতি বয়সী যুবক ছেলেরা মিফতিকে দেখলে অপলকে চেয়ে থাকে। আবার অনেকে একনজর দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কেউ আবার অকারণেই আগবাড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসে। এসবই যেন নিত্যদিনের ঘটনা। তবু সবকিছু তাকে মুখবুজে সহ্য করতে হয়। দু-একটা কথা যে মা-বাবার কানে আসে না, তা নয়। তাই তাকে নিয়ে তাদেরও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় থেকেই মিফতির জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। বাবা অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি নন। তার ইচ্ছা মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে চাকরি করাবেন। কিন্তু দিন যতই যায় বাবার চিন্তা ততই বাড়তে থাকে। তার স্বপ্নটাও যেন ভোরের শিশিরের মতো আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে। গ্রামের দুষ্ট ছেলেরা বাবার ইচ্ছা পূরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া লোকজনরা নানা ধরনের কথাবার্তা বলতে থাকেন। মুরব্বিরা মিফতিকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তাদের ধারণা দিনকাল ভালো না। শুভ কাজে দেরি করা ঠিক না। মেয়েকে যত দ্রুত পাত্রস্থ করা যায়, ততই তার মঙ্গল। ওদিকে অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসার ইচ্ছা মিফতির মোটেও নেই। সেও বাবার মতো নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর। মিফতিদের পাশের গ্রামের নাম পীতনগর। এ গ্রামের মেম্বার আসকার আলী মিফতির বাবার বন্ধু। এক দিন সকালবেলায় মেম্বার সাহেব মিফতির বাবা আবুল খায়েরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। স্কুল ছুটি থাকায় মিফতি তখন বাসাতেই ছিল। মেম্বারের সঙ্গে বাবার কথোপকথনের অনেকটাই তার কানে আসে। সে বুঝতে পারে মেম্বার সাহেব মূলত তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। পাত্র তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ছেলের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। বর্তমানে সে ইতালি থাকে। ঢাকাতে তার নিজস্ব একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। সে দুই মাসের ছুটিতে দেশে বেড়াতে এসেছে। বিয়ে করার জন্য পাত্রী খুঁজছে। ভালো পাত্রী পেলে বিয়ে করবে। বন্ধুর কথায় বিশ্বাস করে মিফতির বাবা খুব সহজেই বলে ফেলেন : ‘তুমি যখন বলছ- তা আর ভেবে দেখার কী আছে? তুমি তো আমার অমঙ্গল চাইবে না। আমি আর অমত করব না।’ বাবার কথাগুলো এতটাই পীড়াদায়ক ছিল, তা মিফতির কয়েক দিনের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। তারপর এক দিন জানতে পাওে, বাবা ওই ছেলের সঙ্গেই তার বিয়ে ঠিক করেছেন। আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে। বিয়ের কথা শুনে মিফতির হৃদয়টা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন তার সুদূরপরাহত। কদিন পরেই যে তার এসএসসি পরীক্ষা! তবে কি তার পরীক্ষা দেওয়া হবে না? পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে? বুকের স্বপ্নগুলো কি বিয়ের শৃঙ্খলে বন্দি থাকবে? এ রকম নানা প্রশ্ন তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তার ইচ্ছা করছে, চিৎকার করে বাবাকে জানিয়ে দেবে-সে এই বিয়েতে রাজি নয়। কিন্তু সেই সাহস তার মোটেও নেই। নীরবে চোখের জলে বুকের বসন ভেজানো ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। দুপুরের দিনমনির আলো যেমন দিন শেষে ক্ষীণ হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যায়, ঠিক তেমনি করে মিফতির বুকের ভেতরের তেজি ভাবখানাও ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

অবশেষে অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশে ধুমধাম করে মিফতির বিয়ে সম্পন্ন হয়। নববধূর পা থেকে মাথা পর্যন্ত হীরা, স্বর্ণ ও মুক্তার অলংকারে মোড়ানো। তার মা-বাবা মেয়ের ভবিষ্যৎ সুখের কথা ভেবে খুশি হয়। বিয়ের পরের কয়েকটা দিন মিফতির ভালোভাবেই কেটে যায়। মাসখানিক পর তার স্বামী আবার ইতালিতে পাড়ি দেয়। স্বামীর পরশ পেতে তাকে আবার দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হবে। মিফতি আপাতত তার মা-বাবার কাছেই রয়ে গেল। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর আর তার পড়ালেখা হয়নি। কারণ কিছুদিন পরই তার কোলজুড়ে এক নতুন অতিথির আগমন ঘটে। ছেলের নাম রাখা হয় শুদ্ধ। শুদ্ধকে দেখার জন্য বাবা ইতালি থেকে ছুটে আসেন। দিন দশেক থেকে আবার চলে যান। শুদ্ধ হওয়ার পর থেকে মিফতিকে বেশির ভাগ সময় শ্বশুরবাড়িতেই থাকতে হয়। এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় ১০ বছর কেটে যায়। দু-তিন বছর পরপর শুদ্ধর বাবা কয়েক দিনের জন্য দেশে বেড়াতে আসেন। আবার কিছুদিন থেকে চলে যান। পুতুল খেলার বয়সে মিফতি বধূবেশে স্বামীর সংসারে প্রবেশ করেছিল। তাই কৈশোরের অনেক স্বপ্নই তার অপূর্ণ থেকে যায়। সে ইচ্ছা করলেই এখন আর আগের মতো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশতে পারে না। কথা বলতে পারে না। সে এখন ফুলদানিতে সাজানো গন্ধহীন ফুলের মতো। যার সুবাসে মধু লুটতে কোনো অলি আর ছুটে আসে না। বয়স কম হলেও তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, সে একজন গৃহিণী, একজন মা। শ্বশুরবাড়ির কড়া অনুশাসনের বেড়ি তার হাতে-পায়ে পরানো। বুকের মধ্যে না পাওয়ার বেদনা তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। তার পরও সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। সব কিছুই মাথায় রেখে তাকে চলাফেরা করতে হয়। তাই ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও সে সুখ খুঁজে বেড়ায়।

এদিকে শুদ্ধকে নিয়ে তার মা-বাবা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তাকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। টাকা-পয়সা খরচ করতে তারা কার্পণ্য করবে না। মিফতি তার ছেলে শুদ্ধকে নিয়ে ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে উঠে পড়ে। শুদ্ধকে রাজধানীর ভালো একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রতিমাসে ছেলের লেখাপড়া ও সংসার চালানোর খরচ বাবদ যথেষ্ট পরিমাণ টাকা মিফতির স্বামী বিদেশ থেকে পাঠিয়ে দেয়। গৃহকর্মী সময়মতো বাসায় এসে কাজ করে দেয়। ছেলেকে স্কুলে দেওয়া-নেওয়ার মাঝে আসিফ নামে এক ছাত্রীর বাবার সঙ্গে মিফতির পরিচয় হয়। আসিফ সাহেব ছোটখাটো ব্যবসায়ী। পরিচয়ের সূত্র ধরে একপর্যায়ে সে মিফতিদের বাসাতে যাতায়াত শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার সঙ্গে মিফতির ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। হৃদয়ে জমে থাকা দীর্ঘদিনের অতৃপ্তি আসিফ সাহেবের সংস্পর্শে অনেকটা নিচে নামতেই বাধ্য করে মিফতিকে। যে অমিয় সুধায় তৃষ্ণার্ত হৃদয় দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা আবার আসিফের পরশে জাগ্রত হয়। বুকের মাঝে সে একটা সাহসও অনুভব করে। লোক-লজ্জার ভয়কে সে এখন পদদলিত করতে দ্বিধা করে না। শুধু ভয় পায় তার সন্তান শুদ্ধকে। মনের অজান্তেই সে যেন শুদ্ধকে তার নব সুখের অন্তরায় ভাবতে শুরু করে। কারণ বাসায় আসিফ সাহেবের উপস্থিতি এবং তার সঙ্গে কথা-বার্তা, হাসি-তামাশা শুদ্ধ যে অপছন্দ করে তার প্রমাণও সে বেশ কয়েকবার পেয়েছে।

এক দিন বিকালবেলায় শুদ্ধ কোচিং সেন্টারে যায়। প্রতিদিনের মতো তার ফিরতে সেদিনও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক দেরি হবে। বাইরে হিমেল হাওয়া বইছে, সঙ্গে হালকা বৃষ্টিও। বড্ড অস্থির লাগছে মিফতির। তনুর উষ্ণ স্পর্শে ক্ষণিকের জন্য হলেও সে অন্য কোথাও হারিয়ে যেতে চায়। এমন সময় মোবাইলের রিং টোন তাকে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। মোবাইলের স্ক্রিনে আসিফের নামটা ভেসে ওঠা দেখেই তার মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। আসিফকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল রিসিভ করেই সে তাকে বাসায় আসতে বলে। আসিফও যেন এ রকম একটা কথা শোনার জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। ব্যস! কাল বিলম্ব না করেই সে রওনা দেয়। ওদিকে হঠাৎ করে কোচিং ছুটি হওয়ায় শুদ্ধও বাসায় ফিরে আসে। দরজায় নক করার শব্দ শুনে মিফতি দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে দেখে শুদ্ধ। মিফতি খুব বিরক্ত হয়। এ সময় সে আসিফকে প্রত্যাশা করেছিল। কোচিংয়ে ক্লাস না হওয়ার কথা শুনে সে মাস্টারদের গালিগালাজ করতে থাকে। এর পরপরই আসেন আসিফ সাহেব। সে শুদ্ধকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেয়ে বুঝতে পারে, তার দেরি হয়েছে। শুদ্ধ যেন কিছু বুঝতে না পারে তার জন্য সে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। অসময়ে আসিফ আঙ্কেলকে দেখে শুদ্ধ বিরক্ত হয়। সে তার মাকে বলেই ফেলে, যখন-তখন আসিফ আঙ্কেল আমাদের বাসায় আসে কেন? এখানে যেন আর না আসে। সঙ্গে সঙ্গে মিফতিও শুদ্ধের মুখের ওপর কথার বান ছুড়ে দেয়। সে বলতে থাকে- তোমার আঙ্কেল অবশ্যই আসবে। এর জন্য তুমি কিছুই বলতে পারবে না। শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে আজও আমি এই সংসার করে যাচ্ছি। তা না হলে অনেক আগেই...। কিছুক্ষণের মধ্যে মিফতির চৈতন্য ফিরে আসে। লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে যায়! সে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে। ছোট্ট শুদ্ধ তার মায়ের কথার প্রকৃত অর্থ বুঝতে না পারলেও বাবার প্রতি মায়ের যে প্রচন্ড ঘৃণা জন্মেছে তা বুঝতে তার কোনো সমস্যা হয়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist