আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ২০ অক্টোবর, ২০১৭

গল্প

ব্লু হোয়েল

কলিংবেল টিপতেই আমাদের খান কটেজের সদর দরজা চিচিংফাঁক। ঢুকতে যাব এমন সময় পথ আগলে দাঁড়ায় আমার ইষ্টি মিষ্টি দুষ্ট ভাগ্নিটা। চোখে-মুখে একমুঠো দুষ্টমির ঝিলিক। ওর নাম ইলমা। দুরন্ত এক পিচ্চি মেয়ে। মিষ্টি দুষ্টমিতে বাড়ি মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। এক্ষুনি হয়তো আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে-

ছোট মামা ছোট মামা! বলো তো ফল আগে না গাছ আগে? আচ্ছা ছোট মামা! তুমি যে বললে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠা-া লেগে যাবে, তাহলে হাঁসগুলো যে রোজ পানিতে নেমে থাকে, ওগুলোর ঠান্ডা লাগে না কেন? জানো ছোট মামা! নানুভাইয়া না সারা দিন বইয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। একটি পড়াও শব্দ করে পড়তে পারে না। আচ্ছা! ছোট মামা! পড়া না পাড়ার কারণে নানুভাইয়াকেও কি রোজ অফিসে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়?

এই এক অভ্যাস ইলমার। সারাক্ষণ শুধু অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে দেখলেই ও প্রশ্ন ছুড়তে ভুলে না। তা যদি হয় ভিক্ষে নিতে আসা ছগিরের মাও। এক দিনের ঘটনা। ছগিরের মা এলেন ভিক্ষা চাইতে। তারও কপাল খারাপ। পরল ঠিক ইলমার সামনেই। ইলমা তাকে দেখেই প্রশ্ন ছুড়ে-

বলো তো, কোন জিনিস কাটলে বাড়ে?

ছগিরের মা তো দূরের কথা, ওর প্রশ্ন শুনে আমিই তো হতভম্ব। ইলমার কানের কাছে মুখ রেখে বলি-

হ্যাঁ রে! পৃথিবীতে আছে নাকি এমন কোনো জিনিস? যা কাটলে সত্যিই বাড়ে।

অ্যামা! তুমিও জানো না ছোট মামা? জানবেই বা কী করে? লেখাপড়া কিছু করো? সারা দিন তো শুধু টই টই করে ঘুরে বেড়াও।

দরজায় চোখ রেখে দেখি ছগিরের মা চম্পট। যাক, মানির মান আল্লাহ রাখেন। আমি ইলমাকে আবারও জিজ্ঞেস করি-

বলো না কোন জিনিস কাটলে বাড়ে?

পুকুর।

পুকুর!

হ্যাঁ, পুকুরই তো। যত কাটবে, ততই বাড়বে।

তো ইলমার এভাবে পথ আগলে দাঁড়ানোর মানে যে, নিশ্চিত ওর অদ্ভুত প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া, তা হয়তো এতক্ষণে আপনারাও বুঝে গেছেন। তাই না? ওকে জিজ্ঞেস করি-

কিরে পথ আগলে দাঁড়ালি কেন? কিছু বলবি?

আমার চকলেট?

অ্যারে একদম ভুলে গেছি। সন্ধ্যায় এনে দিই?

না, আমার এক্ষুনি চাই।

কী আর করা! অগত্যা চকলেটের জন্য নিচে নামতে হলো। চকলেট নিয়ে ফিরতেই ও আমার বাঁ হাতে ঝাকুনি দিয়ে বলে-

আচ্ছা ছোট মামা! তুমি কালো কালিতে লাল লিখতে পারো?

বলেছিলাম না? অদ্ভুত সব প্রশ্নই ওর মাথায় ঘুরপাক খায়। বিরক্তি নিয়ে বলি-

হ্যাঁ রে, কে কবে কালো কালিতে লাল লিখতে পেরেছে? যা ভাগ। না হলে দেবো এক কান মলা। কিন্তু ইলমা গেল না। উল্টো তিরস্কারের স্বরে বলে-

খুব তো বলো পড়াশোনা করি, পড়াশোনা করি। আসলে করো শুধু কচু। তা না হলে এত সহজ কাজটা করতে পারলে না? এই আমাকে দেখ। আমি কীভাবে কালো কালিতে লাল লিখি। এই যে আমার হাতে কালো কালির কলম। আমি লিখছি ল-আকার লা, ল। লাল। কী হলো তো?

ওরে পাকা বুড়ি! আমি এই বলে যেই ওর ছোট চুলের তালগাছ ধরব, ঠিক তখনই ও হরিণছানার মতো তিড়িং বিড়িং করে দৌড়ে পালাল। এমনই আদরের ভাগ্নি আমার। অথচ আজ ওকে দেখি না কত দিন হয়ে গেল! উচ্চশিক্ষার জন্য আমাকে চলে আসতে হলো সুদূর লন্ডন। শুনেছি এ ক’বছরে নাকি সেদিনের এক রত্তি পাকাবুড়িটাও অনেক বড় হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনায় বরাবরই ফার্স্ট ক্লাস। গেল বছরে জেএসসিতে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পেয়েছে। আমার কাছে আবদার করেছিল একটি আইফোনের। মা মরা এতিম ভাগ্নি আমার। ওর চাওয়া কি আর অপূর্ণ রাখতে পারি? তাই ওরই পছন্দের ব্র্যান্ড কিনে দিই। ফোন পেয়ে সেকি আনন্দ আমার ইষ্টি মিষ্টি ভাগ্নিটার। কিন্তু কে জানত? এই ফোনই যে এক দিন কাল হয়ে দাঁড়াবে ওর জীবনে। সেদিন মা ফোন করে বলেন-

ইলমা যেন কেমন হয়ে গেছেরে!

কেমন হয়ে গেছে মানে?

সারাক্ষণ শুধু মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। পড়ালেখায় একটুও মনোযোগ নেই। নেই আগের মতো দুরন্তপনাও। চুপটি করে বসে থেকে কী যেন ভাবে। প্রায় রাতেই ছাদে গিয়ে পায়চারি করে। জিজ্ঞেস করলে বলে-

আকাশ দেখছি।

হ্যাঁ এটা সত্য। আকাশ ওর খুব পছন্দ। আর এটা হয়েছিল আমারই জন্যে। ছোটবেলায় ও যখন কান্না করত তখন আমিই ওকে আকাশ দেখাতাম। শরতের আকাশে তখন সাদা মেঘের পরিরা ডানা মেলে উড় তো। মেঘেদের ওড়াওড়ি দেখে ইলমা কান্না থামাত। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। মাঝেমধ্যে বলত, আচ্ছা মামা! মা ওকি আকাশে মেঘেদের মতো ঘুরে বেড়ায়?

মা বলছিলেন ইলমাকে না জানিয়ে নাকি কোনো কবিরাজ থেকে তেল পড়া এনেছিলেন। যদি ভূত-প্রেতের আছর পরে! তাই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

মাকে বললাম-

শোনো মা! বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতার যুগে তুমি এখনো সেকেলেই রয়ে গেলে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোদের এই বিজ্ঞানই যত নষ্টের মূল। কী সব আজগুবি জিনিস আবিষ্কার করে, যা উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করে তিন গুণ। এই যে তুই মোবাইল ফোনটা দিলি, এর পর থেকেই তো ও কেমন যেন হয়ে গেল। নতুবা নাতনিটা আমার কত হাসিখুশির ছিল।

আচ্ছা ঠিক আছে। বিজ্ঞান আর আমাকে তুমি যত ইচ্ছে বক। কিন্তু তার আগে ইলমাকে কোনো সাইকোলজিস্ট দেখাও।

কিন্তু তত দিনে জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলে ইলমাকে কল দিই। তিনবার রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ হয়। ইলমার গলাটা বসা বসা মনে হলো।

কেমন আছো ছোট মামা?

হ্যাঁরে মা, তোদেও দোয়ায় বেশ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?

হ্যাঁ, খুব ভালো।

তুই কিন্তু ইদানীং আমাকে কল দিস না। কী হয়েছে তোর? পড়াশোনার খুব চাপ?

হ্যাঁ মামা। সামনে পরীক্ষা তো, তাই।

তোর কিছু লাগবে?

না মামা।

আচ্ছা লাগলে বলিস।

মামা!

কিছু বলবি?

আচ্ছা মামা! নীল তিমিদের কি অনেক দুঃখ?

ভাগ্নির এই অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে আমি মনে মনে খুশিই হই। যাক ভাগ্নি আমার আগের মতোই আছে। মা শুধু শুধু আমাকে টেনশন দিচ্ছিল। ভাগ্নির প্রশ্নে বরাবরের মতোই বলি-

কী জানি!

সেদিনের পর আর কথা হয়নি ভাগ্নির সঙ্গে। আর কখনো হবেও না। সেই সম্ভাবনার দরোজা বন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। গত পরশু দিন বাবার ফোন দেখে চমকে উঠি। কেননা বাবা তেমন কোনো জরুরি বিষয় না হলে ফোন করেন না। ফোন ব্যাক করতেই বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কলজে চিন চিন করে ওঠে। মার কিছু হয়নি তো! বাবা কান্না ভেজা গলায় বলেন-

ইলমা আর নেই...

মানে!

ও আত্মহত্যা করেছে।

সেদিনই উড়াল দিলাম। আমার সামনে রাখা হলো আমারই আত্মার লাশ। লাশের সঙ্গে ওর রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট। ওতে বড় বড় করে লিখা রয়েছে-No one is responsible for my death। আর এই লেখাটির পাশেই আঁকা ছিল একটি হাসির চিহ্ন। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই আমার সেই ইষ্টি মিষ্টি দুষ্ট ভাগ্নিটা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আমি ইলমাকে ডাকি-

পাকাবুড়ি!... পাকাবুড়ি!... চকলেট নেবে না? এই দেখো মামা তোমার জন্য কত চকলেট এনেছি।

কিন্তু আমার পাকাবুড়িটা আর উঠল না। জিজ্ঞেস করল না ‘ছোট মামা! তারারা দিনের বেলায় এত ঘুমায় কেন’? ওর সব অদ্ভুত প্রশ্ন কেড়ে নিয়েছে সুইসাইড গেম ‘ব্লু হোয়েল’।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist