তমাল ফেরদৌস
ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী সম্প্রদায়
মণিপুরীরা প্রায় আড়াইশ বছর আগে মণিপুর রাজ্য ছেড়ে প্রথম বসতি স্থাপন করে এই বাংলায়। এই জনগোষ্ঠীর প্রথম যাত্রা শুরু হয় মহারাজ গরিব নেওয়াজ ও মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে। এর আগে থেকেই মণিপুরে হিন্দুধর্মের বিশেষত চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের প্রবেশ ঘটে। তখন উৎসাহী ধর্ম প্রচারক এবং প্রতিভাবান মণিপুরী গুরুদের সম্মেলনে বাংলার কীর্তন মণিপুরে নবজন্ম লাভ করে। সে সময় মণিপুরী নট-সংকীর্তন, নিপা পালা, নুপী পালা, খুবাক ঈশে, বাসক ঈশে প্রবল জনপ্রিয়তা পায়। রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রবিপ্লবের কারণে মণিপুরী প্রব্রজনকারী বৃহত্তর সিলেটসহ তৎকালীন ময়মনসিংহের দুর্গাপুর ও ঢাকার তেজগাঁওয়ে আশ্রয় নেয় এবং তাদের অনেকেই ছিলেন বিশিষ্ট নট-সংকীর্তন গায়ক, মৃদঙ্গ বাদক বা বাসক গানের শিল্পী। এ সময় মন্দির স্থাপন করে ইষ্টদেবতার পূজা-অর্চনা এবং নানা পূজা-পার্বণ ও ধর্মীয় সংস্কৃতিচর্চা শুরু হয়। পরবর্তীতে মণিপুরী বিশিষ্ট গুরু ও নৃত্যগুরুরা সংস্কৃতি চর্চাকে আরো বেগবান করেছেন। বাংলাদেশে মণিপুরী চর্চার সমগ্র সময়কাল বসতি স্থাপনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ, ১৯০১ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে চলতি সময়কাল পর্যন্ত এই তিন পর্বে ধরা হয়েছে।
প্রথম পর্যায় :
মণিপুরীদের বাংলাদেশে অভিবাসন অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হয়ে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থেকেছে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৮৯৯ সালে ইঙ্গ-মণিপুরী যুদ্ধে মণিপুরী বাহিনী পরাজিত হয় এবং মণিপুর পুরোপুরিভাবেই ব্রিটিশের করতলগত হলে কিছু কিছু মণিপুরী পরিবার বাংলাদেশে চলে আসে। মণিপুরী ঝুলন রাসের সূত্রপাত আনুমানিক দেড়শ’ বছরের আরো আগে বলে মণিপুরের অভিজ্ঞমহল মনে করেন। মৌলভীবাজার জেলাধীন কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে রাস নৃত্যানুষ্ঠানের ১৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। সেই হিসেবে রাসনৃত্যের সূত্রপাত ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশক থেকে। অপর এক সূত্রমতে, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র ত্রিপুরা রাজার কন্যা হরিশেশ্বরীকে বিয়ে করেন। এরপর রাধা মাধবের মন্দিরে রাসনৃত্যানুষ্ঠান শুরু হয়। প্রাপ্ত নথি-পত্রাদি মোতাবেক এটিই ত্রিপুরায় প্রথম রাসনৃত্যানুষ্ঠানের ঘটনা। রাসনৃত্যানুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কৃতির নানা উপাচার যেমন-লাইহারাওবা নৃত্য, থাবল চোংবি, পেনা ঈশে প্রভৃতির চর্চাও পুরোমাত্রায় চলতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায় :
নরোত্তম ঠাকুরের আবির্ভাব ও তিরোধান তিথিতে গুরুকীর্তন নামে নট সঙ্কীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরী প্রজাদের জমিদারবিরোধী ভানুবিল আন্দোলন মণিপুরীদের জন্য গুরুত্ব বহন করে। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত সময়কালেই বাংলাদেশে মণিপুরী চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সময়। সে সময়কালেই ১৮৯৯ সালের নভেম্বরে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীহট্ট ভ্রমণে আসেন এবং তিনি শান্তি নিকেতনে ফিরে গিয়েই মণিপুরী নৃত্য শিক্ষাদান শুরু করেন। এরপর ১৮৯১ সালে সংঘটিত হয় ইঙ্গ-মণিপুরী যুদ্ধ এবং খোংজোম নদীর তীরে অস্তমিত হয় মণিপুরের স্বাধীনতা সূর্য।
তৃতীয় পর্যায় :
পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাজনৈতিক কারণে মণিপুর রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশি মণিপুরীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তদুপরি ভারত-পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্ক এবং পরবর্তীতে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবার মণিপুর ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি জমায়। ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কট, জীবন জটিলতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক বিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যায় নিপা পালা, নুপী পালা, পেনা ঈশে এবং অবলুপ্তপ্রায় লাইহারাওবা জাগোই, থাবল চোংবি, খোংজোম পর্ব। মণিপুরী রাসনৃত্য ‘লাইহারাওবা’ নৃত্যের ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত। লাইহারাওবা নৃত্যের লৌকিক রূপই রাসনৃত্যে এসে ধ্রুপদী চরিত্র ফুটে ওঠে। এ ছাড়াও শ্রাবণ পূর্ণিমাতে রয়েছে ‘ঝুলনরাস’। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসবে উপস্থিত ছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
রাসলীলা :
‘রাসলীলা’ বলতে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও অন্যান্য গোপীগণ যে লীলা-খেলা করেছেন তাকেই বোঝায়। মণিপুরী সমাজে শারদীয় মহারাস, বসন্ত রাস, নিত্য রাস, কুঞ্জ রাস, গোপী রাস ও উদখুল রাস প্রচলিত রয়েছে। প্রতিবছর শারদীয় পূর্ণিমা তিথিতে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের জোড়াম-পে এই মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। রাসলীলায় বংশীধ্বনি, সংজল্পন, রমণখেলা, অন্তর্ধান, আবির্ভূত আসনে বসন, প্রশ্ন কুটোত্তর, নৃত্যলাস, কুঞ্জেরহ, বাড়িখেলা ও বনবিহরনম পরিবেশিত হয়। এ সময় রাধা গোবিন্দের লীলায় পূর্বরাগ, প্রেমবৈরিত্য, মান ও মাথুর এবং সংক্ষিপ্ত, সম্পন্ন, সম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধিমান নামে বিরহ ও মিলন নৃত্য পরিবেশিত হয়।
"