মাসউদুল কাদির
হাতকড়া
১.
- উস্তাদ থামান, চেক আছে।
- ওই বেটা, পেছনে তো নাম্বার আছে, থামাইলে চলব?
- উস্তাদ, কথা কইয়েন না। বিপদ আছে। পুলিশগো ভাব ভালা না।
- যা, তোগো কথা না হুইন না উপায় আছে? ডানে-বামে যেমনে যাইতে কস, অমনেই চলতে অয়।
- উস্তাদ, খেরপা লাইগা গেছে। আধা ঘণ্টা নাই উস্তাদ।
- ওই বেটা, এইসব কী কস!
- থামান উস্তাদ।
- পুলিশ।
- ‘ওই বেটা ড্রাইভার, স্টার্ট বন্ধ কর’- ফাটা কণ্ঠে বলল পুলিশ।
- ‘উস্তাদ, এই বাসে কিচ্ছু নাই! খালি খালি সময়টা পাস করলেন স্যার।’- বলল হেলপার
- ‘চুপ কর। তোরা সবকিছুর সঙ্গেই আছোস।’- বলল পুলিশ
- ‘আল্লাহর কসম স্যার! কিচ্ছু জানি না। ভালো কইরা চেক করেন স্যার। গরিবের পেটে লাত্থি দিয়েন না স্যার।’- বলল হেলপার
২.
বাসের শেষ দিক থেকে বামে দ্বিতীয় কাতারে বসে আছেন একজন মাওলানা সাহেব। আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে তার ডান পাশটা অনেকটা অন্ধকার করে রেখেছে সানগ্লাস পরা এক যুবতী। চোখের পুরোটাও ঢেকে আছে কালো চশমায়। সঙ্গত কারণেই তাকে কোনোভাবে আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। দূর থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই, মাওলানা সাহেবের পাশে বসে আছে কোনো নারী। নওজোয়ান এই মাওলানা তার পাশে বসা যুবতীর সঙ্গে কথায় মগ্ন। এতটাই মগ্ন যে, গাড়িতে কী হচ্ছে, সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, চশমাটা একটু ওপরে-নিচে যাচ্ছে। তার মানে, ঘুমুচ্ছে না এই নারী। মুগ্ধ শ্রোতাই বটে! ভালো লাগার কারো সঙ্গে হারিয়ে গেলে কখনো কখনো মানুষ এমনই করে থাকে।
- পুলিশ চেঁচিয়ে বলছে, ‘এই ব্যাগ কার?’
- চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন তরুণ মাওলানা। কোনো গুরুত্বই দিলেন না তিনি। বললেন, ‘এই তো আমার।’
আবার তিনি মনোযোগী হলেন কথায়। কোনো পাত্তাই দিলেন না পুলিশের ডাকে। ওদিকে পুলিশ নিথর হয়ে গেল মাওলানা সাহেবের কথা শুনে। পুলিশ নিজেও কিছু বুঝতে পারছিল না। একটু থামল। নিচে তাকিয়ে দেখল, আরো একটা কিসের প্যাকেট যেন সিটের নিচে ঢুকানো। একটা কোনা বেরিয়ে আছে। ওটার ওপর আবার একটা তোয়ালেও জড়ানো আছে। এবার পুলিশ আগুন হয়ে বলল, ‘এই যে মোল্লা সাহেব! নিচের ওই প্যাকেট কার?’
- ‘যান, ওটাও আমার।’
এবার মাওলানা সাহেব একটু যেন ভাবলেন। তোয়ালেটা নিজের হাতে তুলে নিলেন। মোল্লা সাহেব বলায় বিরক্তি বোধ করলেন। এতে তার কথা, আলাপচারিতা একটু থেমে গেল। তখনই পুলিশের বাঁশি। বাঁশির আওয়াজে ডান পাশে থাকা ছোট খুকি রাইদার ঘুম ভেঙে গেল। এবার রাইদার চোখের সামনেই ঘটছে সব। পুলিশ মুখ ছেড়ে গালাগালি শুরু করল, ‘অসহ্য! এই দেশটা আর ভালো হইল না। হুজুর সাইজাও ফেনসিডিল ব্যবসা! দেশটা থাকল কই!’
- এবার পুলিশ হুকুমের সুরে বলল- ‘এই যে, উইঠা পড়েন। খালি হাতে ব্যবসা হয় না। ডানে-বামে ছাড়তে হয়।’
- ‘জ্বী, কী বলছেন এসব। আমি উঠব কেন?’
- ‘এসব এসব মারাইয়েন না। আর কোনো কথা নয়। সোজা নিচে যান। সব কথা হবে থানায়।’
- ‘না, মানে...’
- ‘পুরুষটারে হ্যান্ডকাফ পরাও, আর চালান নিচে নামাও।’
রাইদা সব দেখল। ওর বয়স আর কত হবে- পাঁচ কিংবা ছয়। বাবা রফিক মোল্লা স্কুলের মাস্টার। মেয়ের আবদার পূরণ করতেই ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছেন তিনি। রাইদার চাচাতো বোন রামিসা। ও কেবলই জাদুঘরের গল্প করে। জাদুঘরে অনেক রকম পাখি, কত রকম জিনিস! এসব গল্প শুনে শুনে আর ভালো লাগে না রাইদার। ও ঢাকায় আসতে চায়। নিজের চোখে দেখতে চায় সবকিছু। রাইদা অনেক খুশি। কারণ, বাবা তার কথা রেখেছে। এবার শুধু জাদুঘরই দেখবে না রাইদা। শিশুপার্কেও যাবে সে। সুযোগ পেলে বাবা তাকে চিড়িয়াখানার জীবন্ত বাঘ দেখিয়ে আনবে। এসব ভাবলে কী যে ভালো লাগে রাইদার! চিড়িয়াখানার জিরাফটা তো অনেক লম্বা। বইয়ের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। সরাসরি দেখলে কেমন লাগবে!- মনটা তার আনচান করে ওঠে। কী ঝিকিমিকি আলোর বন্যা ছড়িয়ে দেয় হাতিরঝিল। এত স্বপ্নিল হাতিরঝিল! লালবাগের কেল্লা এবার দেখবেই সে। এসব ভাবতে ভাবতেই রাইদা ঘুমিয়ে পড়েছিল। শেষে পুলিশের বাঁশিতে জেগে উঠল, দেখল অন্য এক পৃথিবী।
৩.
সাধারণ মানুষগুলোকে চমকে দিয়ে পুলিশ কী সুন্দর পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক মাওলানাকে নিয়ে নেমে যাচ্ছে। ধবধবে সাদা পোশাকে ফেনসিডিল ব্যবসা! সবার কাছেই নতুন কিছু মনে হলো। কেউ কোনোকিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। যেই পুলিশ গাড়ি থেকে নামল, অমনি একজন ভদ্র মহিলা পেছন থেকে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘এবার ছাড়েন। আল্লাহর ওয়াস্তে ছাড়েন। অনেক অইছে।’
সবাই যেন একবাক্যে ওই মহিলার দিকে তাকাল। রাইদাও। এবার ওর বাবাকে বলল, ‘বাবা, বাবা, নিচে চলো, নিচে চলো।’
রাইদার বাবা হয়তো ভেবেছেন, তার ছোট্টমণিটা হয়তো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য নিচে যেতে চাইছে। এই মনে করে বাবা তাকে নিয়ে নিচে গেল। নিচে গিয়েই রাইদা বাবাকে বলল, ‘দেখো বাবা, পুলিশের সামনের প্যাকেটগুলো পেছনের মহিলাটার। যে মহিলাটা চিৎকার করেছে, ওর।’
-‘চুপ! পুলিশ, মামণি! কথা বলে না।’
[ছোট্ট মেয়ে রাইদা। বাবা মুখ চেপে ধরেও তাকে আর চুপ করাতে পারল না ]
- ‘সত্যি বলছি বাবা! আমরা না সবার আগে বসেছি, তখন এই মহিলা প্যাকেট ধাক্কা দিয়ে নিচে রেখেছে।’
এবার পুলিশের কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছে গেল। ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেলেন রাইদার বাবা। পুলিশ কাছে এসে বলল, ‘খুলে বলুন, কী হয়েছে।’ রাইদার বাবার যেন কথা থেমে গেছে। রাইদাকে পুলিশ অনেক সুন্দর করে বলার পরও সে আর মুখ খুলতে পারল না। ভয়ে থতমত খেয়ে গেল। এবার রাইদার বাবা বিষয়টি অনেক বুঝিয়ে বললেন। ততক্ষণে বাসের পেছনের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ে গেছে একজন নারী আর একজন পুরুষ। পুলিশ অনেকটা বস্তা পড়ার শব্দে আঁতকে উঠল।
পুলিশের দৃষ্টি এখন বাসের পেছনের দিকে। দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে।
"