অরূপ তালুকদার

  ২২ এপ্রিল, ২০১৭

হৃদয়ছোঁয়া

কিছুক্ষণ পরেই শায়লার মনে হলো, সে ইতোমধ্যে কোনো ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছে। কিন্তু সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করতে পারছে না। কারণ, সামনের রঙিন গ্লাসটপ টেবিলের ওপাশে চমৎকার চেহারার হাসি হাসি মুখের যে মানুষটি বসে আছেন, তার বিরুদ্ধে এখনো তেমন কোনো অভিযোগ তুলতে পারছে না। সুযোগও পাচ্ছে না।

কতক্ষণ আর, মিনিট পনেরো-বিশেক আগে অনেকটা হুট করেই এই রুমটার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পাশের নেমপ্লেটটার ওপর আলতোভাবে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছিল মাত্র। সবটা দেখার ধৈর্য ছিল না। কিন্তু ভেতরে ঢুকে টেবিলের ওপাশের মানুষটিকে দেখে তো একেবারে হতবাক। এ তো রফিক নয়! কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, বাইরের নেমপ্লেটে রফিকুল ইসলাম নামটিই লেখা ছিল। তবে তার নিচে ছোট করে কিছু একটা লেখা ছিল, সেটা লক্ষ্যই হয়নি। তাহলে?

কিন্তু এই তাহলের উত্তরটা পাওয়ার আগেই টেবিলের ওপরে রাখা ল্যাপটপটা থেকে মুখ তুলে তাকালেন ভদ্রলোক।

‘এক্সকিউজ মি’, একটু যেন নার্ভাস হয়ে গেল শায়লা, ‘আমি মানে... ভুল করে...’

ভদ্রলোক একটু সোজা হয়ে বসলেন। মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটল যেন, ‘ভুল করে মানে!’

‘হ্যাঁ, ভুল করেই তো।’- নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করে শায়লা।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, ভুল কী করেছেন, পরে দেখছি, একটু বসুন’- হাসিমুখেই হাতের ইশারায় চেয়ার দেখান ভদ্রলোক।

‘মানে!’

‘মানে কিছু নয়, আপনাকে একটু বসতে বলছি, অসুবিধে নেই তো?’

শায়লা আলতোভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। ঠা-া, প্রায় নিঃশব্দ সুন্দর একটা অফিসঘরের মধ্যে বসে বেশ ভালো লাগছে শায়লার। বাইরে এখন চড়া রোদ আর গরম।

মানুষটাকে বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে শায়লার। ব্যবহারে মনে হয় কতদিনের পরিচিত, কথাবার্তায়ও তেমন একটা ভাব। আসলে তো এই প্রথম দেখল দুজন দুজনকে।

‘একটু বসুন প্লিজ, হাতের জরুরি কাজটুকু সেরে নিচ্ছি, তারপর শুনব আপনার কথা।’

ল্যাপটপের ওপর দ্রুত আঙুল চলতে থাকে। চোখ স্ক্রিনের ওপর। কিছুক্ষণের জন্য কাজে মগ্ন হয়ে যান ভদ্রলোক।

পাঁচ-সাত মিনিট পরে আঙুল থামে। আলতো করে একটু ঠেলে ল্যাপটপটা সরিয়ে রাখেন একপাশে। তারপর সোজা তাকান শায়লার দিকে।

‘আমি রফিকুল ইসলাম’, এই কোম্পানির সিইও, ‘আপনি তো...’

‘আমি শায়লা, শায়লা আক্তার’, ঢোক গিলে আস্তে করে বলে শায়লা, ‘আমি আসলে...’

কথা শেষ হয় না। সেই মুহূর্তে দরজায় টোকা দিয়ে অনুমতি নিয়ে ফাইল হাতে রুমে ঢোকে এক তরুণী। শায়লা তাকায় তার দিকে। দেখেই মনে পড়ল, এই মেয়েটিকে এক পলক দেখেছিল সে এই রুমে ঢোকার আগে। এই রুমের আগে ডানপাশের ছোট রুমটিতেই বসে সে। মেয়েটি সম্ভবত রফিক সাহেবের পিএ। ঢোকার সময় ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকার কারণে হয়তো শায়লাকে সে দেখতে পায়নি।

‘ফাইলটা এনেছো নাকি, রীনা?’

‘হ্যাঁ, স্যার...’

‘দাও’, হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নিলেন রফিক সাহেব, ‘সব ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

‘ঠিক আছে, তুমি এসো।’

শায়লার দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে চলে যায় রীনা।

‘এবার বলুন, মিস...’

শায়লা।

‘হ্যাঁ, মিস শায়লা, আপনি যেন কী ভুলের কথা বলছিলেন?...’ রফিক সাহেবের মৃদু হাসিটা আবার পরিষ্কার দেখতে পায় শায়লা। মুখে তো তেমন কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না।

‘না, মানে...’ শায়লা কী বলতে গিয়ে থেমে যায়।

‘না, না, আপনার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ভুল তো মানুষের হতেই পারে। আপনারও না হয় তেমন কিছু একটা হয়েছে। বলুন...’

মাথা নিচু করে বসে থাকে শায়লা। আসলে ঠিক এই মুহূর্তে কী বলবে বা কী বলা উচিত, সেটা ভাবতে ভাবতেই যেন ভেতরে ভেতরে সংকোচ বোধ করছিল সে। আর সেটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছিল। তবু একসময় সে বলে ওঠে, ‘মানে, আমি নামের সঙ্গে সম্ভবত মানুষ গুলিয়ে ফেলেছি।’

এইটুকু বলে একটু থেমে আবার বলে, ‘আসলে আমি যে রফিক সাহেবকে খুঁজছি, তিনি আপনি নন, স্যরি...’- কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে শায়লা। এখন যেন এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াটাই জরুরি।

‘তাই বলুন’, শব্দ করেই হেসে ওঠেন রফিক সাহেব, ‘কী হলো, বসুন না...’

‘না, মানে...’ বসতে বসতে আরো অস্বস্তি বোধ করে শায়লা। ইঁদুর খেলার ব্যাপারটা আবার মনের মধ্যে উঁকি দেয়।

‘শুনুন’, রফিক সাহেব বলতে থাকেন, ‘সত্যি বলতে কী, রফিক নামটা এত কমন যে, হঠাৎ আপনার মতো ভুল যে কারোই হতে পারে। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।’

শায়লা কথা বলে না। আনত মুখে টেবিলের কাচের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের আবছা ছায়াটাকে দেখতে থাকে।

‘আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো...’

রফিক সাহেবের কথা শুনে শায়লা মুখ তুলে তার দিকে তাকায়।

‘ঠিকানাটা কি ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ’- শায়লা মৃদু স্ব^রে বলে, ‘তার ভিজিটিং কার্ডে এই ঠিকানাটাই লেখা ছিল।’

শায়লা কথা বলতে বলতে পরিষ্কার দেখল, রফিক সাহেবের ভ্রু দুটি যেন একটু কুঁচকে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আবার সোজা হয়ে গেল।

বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি।’

শায়লা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘কী বুঝতে পেরেছেন?’

‘আপনার ভুল হয়েছে, তবে অর্ধেকটা...’

‘অর্ধেকটা?’, শায়লা অবাক হয়ে যায়, ‘মানে!’

‘নামটি আপনি ঠিকই দেখেছেন, মানুষটি ভুল, ঠিক তো?’

রফিক সাহেব তাকালেন সোজাসুজি শায়লার দিকে, ‘আপনি যে রফিক সাহেবকে খুঁজছেন, তিনি এই অফিসেই কাজ করেন। সিনিয়র মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ। কিন্তু...’

শায়লা তাকিয়ে থাকে রফিক সাহেবের মুখের দিকে।

‘কিন্তু আজ তো তিনি অফিসে নেই। দুই-তিন দিনের জন্য ময়মনসিংহ গেছেন। কাল বা পরশু আসবেন, সেরকমই জানি।’ একটু থামেন, রফিক সাহেব পরে বলেন, ‘আসার আগে একটু যোগাযোগ করে এলে বোধ হয়...’

শায়লা এখন ঠিক কী বলবে, বুঝতে পারছিল না। তবে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে ঠিক বুঝতে পারছিল, রফিক সাহেব তাকিয়ে আছেন তার দিকেই। এতে ভেতরে ভেতরে শায়লার অস্বস্তি আরো বাড়ে।

শায়লা কিভাবে বলবে, বেশ কিছুদিন ধরে রফিকের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ নেই। তাই এখানে তাকে না জানিয়েই সরাসরি চলে এসেছে সে। তার ওপর কয়েকদিন আগে রফিকের সঙ্গে এই অফিসেরই একটি মেয়ের অন্তরঙ্গতার খবরও সে পেয়ে গেছে তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে। সে রফিককে ভালোভাবেই চেনে। ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ত। শায়লার সেই বান্ধবী কাজ করে একটি ব্যাংকে। থাকে ধানমন্ডিতে। তার ফ্ল্যাটেই এসে উঠেছে সে।

এর মধ্যে রীনা মেয়েটি আবার এসে ঢুকল ভেতরে। একটু আগে ইন্টারকমে তাকেই আসতে বলা হয়েছিল সম্ভবত।

‘আজকে কি আর কোনো প্রোগ্রাম আছে?’

‘৪টায় একটা ইন্টার্নাল মিটিং আছে স্যার’- রীনা জানায়।

‘ঠিক আছে।’ রফিক সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন একবার। বললেন, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যে সবাইকে বলে রাখবে, ‘মিটিংয়ে যেন কেউ অ্যাবসেন্ট না থাকেন। ঠিক আছে?’

‘ওকে স্যার’- রীনা চলে যায়।

রীনা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার যেন কাকে আসতে বললেন রফিক সাহেব।

মিনিট দশেক পরে ফর্সামতো একটি মেয়ে অনুমতি নিয়ে ঢুকল, ‘স্যার...’

‘ফারজানা, যেহেতু রফিক সাহেব আজ অফিসে নেই, তাই গত মাসের মার্কেটিং স্টেটমেন্ট আর প্রমোশনাল ফাইলটা নিয়ে আপনি আজকের মিটিংয়ে থাকবেন। স্টেটমেন্ট রেডি হয়েছে?’

‘কিছুটা বাকি আছে’, ফারজানা মৃদু স্বরে বলে।

‘এখন তো বাকি থাকার কথা নয়’, রফিক সাহেব বললেন, ‘যতদূর রেডি করতে পারবেন, সবটাই নিয়ে আসবেন। বাকিটা উইদিন থ্রি ডেইজ রেডি করে ফেলবেন। ঠিক আছে?’

‘ওকে স্যার, চেষ্টা করব।’- ফারজনা মৃদু স্বরে বলে।

‘আসুন।’

নিঃশব্দে চলে যায় ফারজানা। ঘরের মধ্যে এসিটা চলার শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।

‘মিস শায়লা, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’- আবার হাসিখুশি চেহারায় ফিরে এলেন রফিক সাহেব।

শায়লা তাকিয়ে থাকে। মনের ভেতরে কিছুটা ভয় কাজ করে।

‘আপনি কি ঢাকায়ই থাকেন?’

‘না, রাজশাহীতে থাকি। শহরের বাইরে একটা কলেজে পড়াই।’

‘নিশ্চয়ই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, নাকি অন্য কিছুতে।’

‘আপনি ঠিক বলেছেন’, শায়লা বলে, ‘বুঝলেন কী করে?’

‘আপনাকে দেখে। যাক, রফিক সাহেব তো যতদূর মনে করতে পারছি, রাজশাহীরই মানুষ, তাই না?’

‘হ্যাঁ, আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে তাদের বাড়ি। পারিবারিকভাবে আমরা পরিচিত।’

‘তাই বলুন! আমি উঠব।’- মৃদু হাসেন রফিক সাহেব।

‘এবার আমি উঠব’, শায়লা উঠে দাঁড়ায়, ‘সত্যিই আপনার একটা সময় নষ্ট করেছি আমি, স্যরি...’

‘একটা কথা বলবো?’

শায়লা তাকায় রফিক সাহেবের দিকে।

‘আমি বলছিলাম কী, যদি আপনার অন্য কোনো অসুবিধা না থাকে, তাহলে কি আজ আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করতে পারি না?’

‘না না’, শায়লা বাধা দেয়।

‘শুনুন, আফটার অল আপনি কিন্তু আমাদের গেস্ট’, রফিক সাহেব আস্তে উঠে দাঁড়ান, ‘আপনি যার কাছে এসেছিলেন, তিনি আমাদের সহকর্মী। আপনি তার গেস্ট, সেক্ষেত্রে উনি যখন এখানে নেই, তখন তার দায়িত্বটা কি আমি নিতে পারি না?’

‘আপনি শুধু শুধু’, শায়লার কণ্ঠে অস্বস্তি ঝরে পড়ে।

‘প্লিজ, এরপরেও কি আমার অনুরোধ রাখবেন না?’

শায়লা দঁাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। কী বলবে, বুঝতে পারে না। মনে মনে অন্য একটা কথা ভাবতে থাকে। ঢাকার বড় বড় কিছু অফিস আর তাদের বসদের সম্পর্কে ভালো-মন্দ মিলিয়ে নানা কথা শুনেছিল শায়লা। এতদিন, বিভিন্ন সময় শুনেছে ভয়ংকর সব গল্প। আজকেও কি তেমন কোনো গল্প তৈরি হতে যাচ্ছে? ভেতরে ভেতরে অজানা সেই আতংকের রেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে শায়লার যেন সব কেমন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। ধানমন্ডির যে রেস্টুরেন্টটায় রফিক সাহেব শায়লাকে নিয়ে এসে ঢুকলেন, শায়লার মনে হলো, এটার সামনে দিয়ে আরো দু-একবার সে যাতায়াত করেছে। এর কাছাকাছি একটা চারতলা ফ্ল্যাটে থাকে তার বান্ধবী।

রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই শরীর জুড়িয়ে গেল। চারদিকের সব টেবিলেই লোক বসে আছে। খাওয়া-দাওয়া চলছে, কিন্তু কোথাও কোনো শব্দ নেই। কথাবার্তা যা হচ্ছে, নিচু স্বরে। ওয়েটার এসে ওদের দুজনকে কোনার দিকের একটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে গেল।

টেবিলের ওপর থেকে মেনুচার্টটা তুলে নিলেন রফিক সাহেব। তারপর তাকালেন শায়লার দিকে, ‘বলুন, কী পছন্দ আপনার?’

‘আমি জানি না। আপনার যা খুশি...’

‘উহু, গেস্ট ফার্স্ট’, হাসতে হাসতে বললেন রফিক সাহেব। কোনো কথা বলে না শায়লা, সলাজ ভঙ্গিতে চুপ করে থাকে। রফিক সাহেবের চোখে শায়লার এই লাজনম্র চেহারাটা এক অপার্থিব মুগ্ধতায় ভরে ওঠে। গায়ের রংটা যদিও একটু চাপা, কিন্তু তা যেন উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে গোলাপি রঙের সুতির স্ট্রাইপ্ড শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে। লম্বাটে গড়ন, মাথার ঘন কালো চুল একটা এলোখোঁপার বাঁধনে ঘাড়ের ওপর স্থির হয়ে আছে। গলায় একটা চিকন স্বর্ণের চেইন মাঝে মাঝে চিকচিক করে উঠছে আলোর দ্যুতিতে। আয়ত চোখে হালকা লজ্জার ছায়া। এমন নিরাভরণ বাঙালি ললনার চেহারা কবে কোথায় দেখেছেন, মনে করতে পারলেন না রফিক সাহেব। তবে বুঝতে পারেন, মনের একেবারে গহিনে এমনই একটা কাব্যিক চেহারা তার অজান্তেই দীর্ঘদিন লুকিয়ে ছিল, অধরা এক স্বপ্নের মতো।

রফিক সাহেব আর জোর করলেন না। বললেন, ‘ঠিক আছে, আমিই বলছি।’- পরে বেয়ারাকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিলেন।

‘মিস শায়লা, একটি কথা জিজ্ঞেস করব?’- রফিক সাহেব আস্তে জিজ্ঞেস করলেন।

শায়লা মাথা নেড়ে সায় দেয়।

‘রফিক সাহেবকে বোধ হয় আপনি অনেকদিন ধরেই চেনেন-জানেন। বলেছিলেন, পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘এবার তার সঙ্গে দেখা করেই যাবেন তো?’

শায়লা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। পরে বলে, ‘ঠিক তেমনটা নয়। আমি আজ না গেলেও কাল ফিরে যাব ভাবছি।’

‘এতদূর এলেন, দেখা না করেই চলে যাবেন?’

‘তেমন জরুরি কিছু নয়’, শায়লা বলে, ‘দেখা এবার না হলেও ক্ষতি নেই।’

‘সেটা ঠিক আছে’, মৃদু হেসে রফিক সাহেব বলেন, ‘তবে তার সঙ্গে দেখা হলে একটা ভালো খবর পেতেন হয়তো।’

‘ভালো খবর!’ একটু অবাক হয়ে তাকায় শায়লা।

‘কেন, আপনি রফিক সাহেবের এনগেজমেন্টের ব্যাপারে কিছু জানেন না? তাহলে তো...’- রফিক সাহেব যেন একটা খুশির খবর শোনাবেন শায়লাকে। ঠা-া ঘরের মধ্যে বসেও শায়লার সমস্ত শরীর যেন অজান্তেই কেঁপে ওঠে। মেরুদ- বেয়ে একটা শীতল অনুভূতির স্রোত নেমে যাচ্ছে শায়লার। মুহূর্তের মধ্যে শায়লার মনে হয়, তার বান্ধবী তাহলে ঠিক খবরই দিয়েছে। অথচ সেই রফিক দিনের পর দিন কেমন মিষ্টি মিষ্টি করে ভালোবাসার কথা বলে কত রকম স্বপ্ন দেখিয়েছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজেকে বড় বোকা মনে হতে থাকে শায়লার। বুক কাঁপিয়ে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

‘আরে ওই যে দেখলেন না’, হঠাৎ রফিক সাহেবের কথা শুনতে পায় শায়লা, ‘আমাদের বেরোবার আগে যে ফর্সা মেয়েটি ঢুকেছিল আমার চেম্বারে, ওর নাম ফারজানা। একই সেকশনে কাজ করে। শুনেছি, ওর সঙ্গেই নাকি সব ঠিক হয়ে গেছে।’

এর মধ্যে বেয়ারা চলে আসে। খাবারের প্লেটগুলো একে একে নামিয়ে দেয় টেবিলের ওপর। শায়লার মনের ভেতরে তখন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। রফিক সাহেব যা বললেন, তার মধ্যে মিথ্যা কিছু থাকার কথা নয়। রফিক সাহেব বোধ হয় কিছু বলছিলেন, ঠিক শুনতে পেল না শায়লা।

‘কী ব্যাপার, আপনি এতটা অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছিলেন। আর অহেতুক সংকোচ করবেন না, প্লিজ, বুঝতে পারছি, আপনার সেই রফিক সাহেব এখন থাকলে অনেক ফ্রি থাকতেন। ঠিক না?’

‘আপনি ওভাবে বলছেন কেন?’

‘না, আমি ভাবছিলাম, হয়তো কোনো বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি’, মুখ থেকে হাসিটা আস্তে মিলিয়ে যায় রফিক সাহেবের।

‘সত্যিই তেমন কিছু নয়’, শায়লা বলে, ‘আপনি তো ভুল কিছু বলেননি।’

‘যাক এসব, শুরু করুন তো এবার।’ বলতে বলতে প্লেটে খাবার তুলে দিতে থাকেন রফিক সাহেব। শায়লাও হাত লাগায়। খেতে খেতে শায়লার মনের মধ্যে পেছনের অনেকগুলো স্মৃতি ভেসে উঠতে থাকে। সেই সঙ্গে রফিকের নানা রকম কথা আর প্রতিশ্রুতি। সবটাই এখন স্বপ্ন মনে হয় শায়লার কাছে, যদিও তার ধারণা, ফারজানার সঙ্গে তার সর্ম্পকটা তৈরি হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। আর তারপর থেকেই সূচিত হয়েছে রফিকের এই পরিবর্তন। এখন তো যোগাযোগই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ঘটনা গড়িয়েছে অনেকদূর। শায়লা ভাবে, রফিক সাহেবের সঙ্গে আজ পরিচয় না হলে আরো কিছুদিন হয়তো সে অন্ধকারেই থাকত।

একসময় নীরবতা ভেঙে রফিক সাহেব বলেন, ‘সত্যিই নিজেকে এখন অপরাধী মনে হচ্ছে নিজের কাছেই। আপনাকে বোধ হয় কোনোভাবে হার্ট করেছি বা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছি। স্যরি শায়লা, আমি আসলে এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। আমার সম্পর্কে আপনার মনের মধ্যে কী ধারণা গড়ে উঠেছে। আমি সম্ভবত কিছু বেশি বলে ফেলেছি, যা আমার বলা উচিত ছিল না।’

‘না না, আপনি শুধু শুধু ভাবছেন কেন’, শায়লা বলে।

‘কোনোকিছুই শুধু শুধু নয় শায়লা’, রফিক সাহেব বলেন, ‘কোথাও একটু হলেও সুর কেটেছে বলে মনে হচ্ছে আমার।’

‘এমন মনে হচ্ছে কেন আপনার?’ মৃদু হেসে আয়ত চোখ মেলে তাকায় সে রফিক সাহেবের দিকে। পরিবেশটাকে একটু হালকা করার চেষ্টা করে।

‘জানি না। তবে আমি মানুষকে সব সময় খুব হ্যাপি দেখতে চাই।’ একটু থামেন রফিক সাহেব, কী ভেবে আবার বলেন, ‘সব মানুষের মুখে অন্ধকারের বদলে আলো দেখতে চাই। এটা আমার দোষ বা গুণ, যা-ই বলুন না কেন।’

হাসে শায়লা। বলে, ‘আপনি খুব ভালো মানুষ রফিক সাহেব।’

‘আপনি বলছেন’, হেসে ওঠেন রফিক সাহেব, ‘আপনার এই কমপ্লিমেন্ট আমার মনে থাকবে।’

‘আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন’, শায়লা বলে, ‘কবিতা লিখলে ভালো করতেন।’

‘কবিতা যে কখনো লিখিনি তা নয়, লিখেছি। কিন্তু...।’

‘কিন্তু কী?’

‘শোনানোর লোক পাইনি। যাকগে, বাদ দিন এসব।’

শায়লা রফিক সাহেবের দিকে তাকায়। তারপর মুখ নামিয়ে নিয়ে চুপ করে থাকে। সেখানে তার অজান্তেই লাগে রঙের ছোঁয়া।

রফিক সাহেবের চোখের সামনে শায়লার আলগা খোঁপাটা ভাসতে থাকে। ঘাড়ের ভাঁজ থেকে নেমে আসা স্বর্ণের চেইনটা আবার চিকচিক করে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা একটা শ্বাসকে আস্তে ছেড়ে দেন রফিক সাহেব। চোখ নামিয়ে আনেন টেবিলের ওপর।

শায়লা এতক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। ইচ্ছে করেই রফিক সাহেবের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারপরও মনের ভেতরে ঝড়ের রেশ রয়েই গেছে।

‘আমার জন্য আপনার বোধ হয় অনেক সময় নষ্ট হলো’, শায়লা বলে।

কিছুটা চমকে হাতঘড়ির দিকে তাকালেন রফিক সাহেব। বললেন, ‘না, তেমন কিছু দেরি হচ্ছে না। আর কী বলব, আপনি তো কিছুই খেলেন না। অথচ আপনার কথা ভেবে একেবারেই দেশি ডিশ নিয়েছিলাম। তাও খেতে পারলেন না।’

মাথা নিচু করেই থাকে শায়লা। রফিকের কথা শোনার পর ভেতরে ভেতরে খুবই মুষড়ে পড়েছিল। কিন্তু রফিক সাহেব যে বিষয়টি এভাবে লক্ষ করবেন, তা একেবারেই বুঝতে পারেনি।

বিশ-পঁচিশ মিনিট পর দুজনে রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে দাঁড়ায়।

‘আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ...’, শায়লা বলে, ‘আমার জন্য আপনারও ঠিকভাবে খাওয়া হলো না।’

‘তাই নাকি’, হাসলেন রফিক সাহেব, ‘তাহলে তো আবার গিয়ে টেবিলে বসতে হয়।’

রফিক সাহেবের কথা শুনে এবার শায়লাও হেসে ফেলে।

‘বাহ্।’

‘কী হলো’- শায়লা অবাক হয়ে তাকায়।

‘তবু আপনার হাসিটুকু দেখতে পেলাম।’

শায়লার আয়ত চোখের ভ্রুকুটি দেখা গেল আবার, অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আপনি না!’

‘যাক, এবার বলুন, আপনাকে কোথায় ড্রপ করব?’ রফিক সাহেব সরাসরি জানতে চাইলেন।

‘না, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি এখন একটা রিকশা নেব। আমার বান্ধবী এই কাছেই থাকে, রাসেল স্কোয়ারের পাশে। ওখানেই উঠেছি আমি।’

‘তাহলে তো পাঁচ মিনিটের ব্যাপার, চলুন।’

‘আপনার আবার সময় নষ্ট হবে, অহেতুক আপনি...’

‘পাঁচ-সাত মিনিটে আর কী হবে, উঠুন প্লিজ।’

গাড়ির কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে তাকান শায়লার দিকে, ‘আসুন...।’

কিছুটা সংকোচ নিয়েই যেন আবার গাড়িতে গিয়ে বসে শায়লা। রফিক সাহেবও উঠলেন। বসতে বসতে বললেন, ‘আপনার কিন্তু রফিক সাহেবের সঙ্গে আজ দেখা হলো না। দেখা করবেন না?’

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় একবার শায়লা। পরে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘না।’

শায়লার কণ্ঠ শুনে কিছুটা অবাক হয়ে শায়লার মুখের দিকে তাকাতেই চোখের সামনে আবার যেন গভীর কালো সেই স্বপ্নের মানুষটিকেই দেখতে পেলেন রফিক সাহেব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist