মোহাম্মদ আলী

  ২২ এপ্রিল, ২০১৭

ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো

চিত্রকলার ধ্যানী দেবদূত

খ্রিস্টান সন্ন্যাসী তিনি। তার চেয়েও বড় পরিচয়, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সুকৌশলী চিত্রী। শুধু তার যুগে কেন, চিত্রশিল্পের ইতিহাসে তার অবস্থান চিরস্থায়ী এক আসনে। তিনি ছবির ছত্রে ছত্রে খোদাই করেছেন মানবতার জয়গান। ইউরোপের সুদীর্ঘ ৫০০ বছরের ধর্মতান্ত্রিক শাসনের ছত্রছায়া ভেঙে যে কয়জন শিল্পী ও মণীষা রেনেসাঁস বা নবজাগরণের জোয়ারে শরিক হয়েছিলেন একজন সন্তের ধ্যানী অনুভব দিয়ে, চরম নৈপুণ্য দেখিয়ে, তাদের মধ্যে অন্যতম ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো। তার আদি নাম ফ্রা জিয়োভান্নি। ধর্মীয় চরিত্র ও বিষয়গুলোকে তিনি এমন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, পরবর্তীকালে তাকে ডাকা হয় ‘বিয়াতো অ্যাঞ্জেলিকো’ (আশীর্বাদধন্য স্বর্গীয় দূত) বলে। সত্যিই তিনি দেবদূত। দেবদূতের মতোই তার সৃষ্টিকর্ম।

শিল্পীজীবনের শুরুর দিকটায় তিনি কাজ করেছেন পান্ডুলিপির একজন ইলাস্ট্রেটর (অঙ্কনশিল্পী) হিসেবে। তিনি যা এঁকেছেন, সবই ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে। সব এঁকেছেন দেয়ালের গায়ে, ভেজা পলেস্তরার ওপর রং চরিয়ে। ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর প্রথমদিকের আঁকা ছবিতে ইন্টারন্যাশনাল গথিক আর্টের প্রভাব সুস্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। একই সঙ্গে গথিক আর্ট ও রেনেসাঁসের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে এগুলোর মধ্যে। গথিক চিত্রকলার দ্বিমাত্রিক আর রেনেসাঁসের ত্রিমাত্রিক অবয়ব দেখে তা বোঝা যায়।

সান ডোমিনিকো ফিয়েসোলে সন্ন্যাসী হিসেবে কাজ করার সময় এঁকেছেন অধিকাংশ ছবি। কিন্তু তার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো এঁকেছেন ফ্লোরেন্সের সানন মার্কোতে, যেখানে তিনি এবং তার সহকারীদের নিয়ে ৫০টির মতো ফ্রেস্কোর কাজ করেন। এখানকার খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক চেতনাকে উদ্দীপিত করার জন্য বাইবেলে বর্ণিত উপাখ্যান অনুসারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাহিনীকে কিছুটা এদিক-সেদিক করে এসব ছবি আঁকেন তিনি। উপাসনালয়ে আঁকা তার অনেক ছবির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে ধরা হয় ‘দি অ্যানান্সিয়েশনকে। অন্যসব ছবির মতো তুলির পেলব আঁচড়ে, উজ্জ্বল রং এড়িয়ে মার্জিত হালকা রঙে তিনি এই ছবিটি আঁকেন। দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের ডানা দুটিতে চড়ান কল্পনার বিভিন্ন রং।

যিশুখ্রিস্টকে তিনি উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তার সমগ্র মাহাত্ম্য দিয়ে, মানবিকভাবে। ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর আঁকা যিশুর মুখাবয়বে রয়েছে শান্ত-সমাহিত ভাব, যা একই সঙ্গে সৃষ্টি করে শান্ত ও করুণ রসের আবহ। বিষয়ের বিন্যাসে সাযুজ্য আর চরিত্রগুলোর মধ্যে শান্ত-সমাহিতভাবে প্রকাশ এবং কোমল রঙের আঁচড় এক অনুপম ও অতুলনীয় অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে শিল্পী ও সন্ত ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোকে। সাধুসন্ত কিংবা প্রেরিত পুরুষদের বিভিন্ন ঘটনাকে তিনি ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন না করে কোনো কোনো ছবিতে বিভিন্ন স্থান ও সময়ের মধ্যে ঐক্য ঘটিয়েছেন। ছবির চরিত্রগুলোর ভাবসমাধিস্থ মুখাবয়ব ও নিশ্চল অবস্থান স্বর্গসুখের আস্বাদকে চিরস্থায়ী করে তোলে যেন। অনেক চরিত্রের উপস্থিতি ঘটিয়েছেন বেশ কয়েকটি ছবিতে। কুমারী মাতা মেরি কিংবা তার শিশুসন্তান যিশুখ্রিস্টকে মহিমান্বিত করার জন্য এই কৌশলের আশ্রয় নেন।

জীবনের শেষভাগে পোপ পঞ্চম নিকোলাসের ব্যক্তিগত উপাসনালয়ে তিনি আঁকেন সেন্ট স্টেফান ও সেন্ট লরেন্সের জীবন নিয়ে অপূর্ব সব ছবি। এসব ছবিতে সান মার্কো বেদিতে আঁকা ছবির তুলনায় আরো বেশি দক্ষ ও সুনিপুণ হাতের ছোঁয়া পাওয়া যায়। এবার তিনি মনোযোগ দেন ছবির বিষয়বস্তু, বিশেষ করে ঘটনায়। আর এগুলোতে ডিটেলের মাত্রা দেন বাড়িয়ে। ফ্রেস্কোতে এই কৌশলের প্রয়োগ তাকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়, যা পঞ্চদশ শতাব্দীর ফ্রেস্কো চিত্রকলার প্রধানতম স্রোতে তাকে নিয়ে যায়।

ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া নভেল্লা উপাসনালয়ের ‘করোনেইশন অব দ্য ভার্জিন’ (কুমারীর রাজ্যাভিষেক) নামের বেদিতে যে ছবিগুলো এঁকেছেন, তার সবই ইঙ্গিত দেয় গথিক আর্টের ধারাকে। স্বর্ণখচিত পশ্চাৎপট, সোনালি মস্তকবলয়, আলখাল্লার সোনালি প্রান্ত আর নীল, লাল ও সবুজ রঙের প্রয়োগ- এসব আমাদের নিয়ে যায় গথিক আর্টের সোনালি অতীতে। তা সত্ত্বেও ছবির চরিত্রগুলোর স্বাভাবিক ও বাস্তব আকৃতি, কাপড়ের স্বাভাবিক ভাঁজ আর ত্রিমাত্রিক গড়ন আনতে তা হয়ে ওঠে সেকালের আধুনিক চিত্রকর্ম। সৃষ্টিকর্তা আর তার প্রজ্ঞা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশকে তিনি এঁকেছেন একজন ধ্যানী সন্তের মন দিয়ে। সান মার্কোর বেদিতে আঁকা চিত্রকর্মে সেই ছাপ সুপষ্ট। উজ্জ্বল রং বাদ দিয়ে মোলায়েম ও হালকা রং ব্যবহার করেছেন, যাতে সাধুসন্তরা মনের মধ্যে প্রশান্তির ভাব আনতে পারে খুব সহজেই।

তার কোনো চিত্রকর্মই ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বাইরে নয়। তার প্রথমদিকের আঁকা কয়েকটি ফ্রেস্কো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিছু ছবি রয়েছে ফিয়েসোলের পুরোহিতদের আবাসস্থলে, যেগুলো অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এখনো টিকে রয়েছে। এর বেদিতে এমন কতকগুলো অপূর্ব ফ্রেস্কো রয়েছে, যাতে ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো স্থান দিয়েছেন আড়াইশ’ মানবমূর্তিকে। সেই সময়কার প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে ভিন্নভাবে ছবির চরিত্রগুলো আঁকেন তিনি। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শিশু যিশুখ্রিস্টসহ মা মেরি ও সাধুসন্তদের নিয়ে আঁকা ছবিগুলোতে দেখা যায়, দাঁড়িয়ে থাকা স্বর্গীয় সাধুসন্তরা যেন তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কিছুটা শূন্যে উড্ডয়ন করতে চাইছেন।

পোপ চতুর্থ ইউজিনাসের আমন্ত্রণে রোমের এক চ্যাপেল বা উপাসনালয়ে আঁকেন কিছু ছবি। দুই-তিনজন সহকারী নিয়ে ফ্রেস্কোগুলো আঁকেন তিনি। পোপ ইউজিনাসের প্রস্তাবিত ফ্লোরেন্সের আর্চবিশপ (পুরোহিতদের প্রধান) পদটি তিনি নিতে চাননি। বরং নিজেকে একজন শিল্পী হিসেবেই তিনি দেখতে চেয়েছেন। এরপর যান ভ্যাটিকানে, সেন্ট নিকোলাসের চ্যাপেলে। সেন্ট লরেন্স ও সেন্ট স্টিফেনের জীবন অবলম্বনে উজ্জ্বল রঙের ফ্রেস্কো আঁকেন। বছর দুয়েক পর ফিরে যান ফিয়েসোলে, যেখানে তিনি পেয়েছিলেন একজন সার্থক শিল্পীর মর্যাদা। গোটা শিল্পীজীবনের কানায় কানায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের প্রকাশকে। যিশুখ্রিস্টের স্বর্গীয় ও যন্ত্রণাহীন মুখাবয়ব এঁকেছেন জীবনভর। এঁকেছেন নিষ্পাপ ও পবিত্র মাতা মেরির অপরূপ সৌন্দর্য।

ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো এমন একজন চিত্রী, যিনি যিশুখ্রিস্টের মহিমা কীর্তন করেছেন দেবদূতের মতো যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে থেকেই। আর তাই তো তার নাম ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist