নূর কামরুন নাহার

  ১৪ আগস্ট, ২০২০

এক ভিন্ন কণ্ঠস্বর

রিজিয়া রহমান

রিজিয়া রহমান বাংলা সাহিত্যে এক অগ্রগণ্য নাম। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক। তীক্ষè পর্যবেক্ষণ, সাধনা-অনুধ্যান দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংযোজন করেছেন এক স্বতন্ত্র ভুবন। বাঙালির নৃ-তাত্ত্বিক ইতিহাস, জাতিসত্তা, জীবন-সংগ্রাম, শ্রমজীবী মানুষের জীবন, মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে তিনি তুলে এনেছেন গভীর নিষ্ঠা, মমতা ও সততায়।

রিজিয়া রহমান শেকড়সন্ধানী লেখক। ইতিহাসের প্রতি একনিষ্ঠতা, মমত্ববোধ, মানুষের জীবনাচারণের প্রতি গভীর পর্যবেক্ষণ তার লেখাকে দিয়েছে ভিন্নতর মাত্রা। ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসে তিনি খুঁড়ে এনেছেন বাঙালির ইতিহাস। গভীর অভিজ্ঞতা, শ্রম, অধ্যবসায়, ইতিহাসজ্ঞান এবং শৈল্পিক চিন্তার এক অপূর্ব সমন্বয় ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসটি। বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল শিল্পকর্ম। ইতিহাস শুধু এখানে নিরেট ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপিত হয়নি, ইতিহাস পরিণত হয়েছে শিল্পে এবং শিল্পসৃষ্টিতে ইতিহাসের পাতায় মিশেছে কল্পনা আর স্বপ্নের বুনন। এ উপন্যাসে রিজিয়া রহমান তুলে এনেছেন হাজার বছরের অবহেলিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষের জীবনাচারণ, তাদের বেঁচে থাকা আর বাঙালি জাতি গঠনের অতীত ইতিহাস। এ উপন্যাস সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য : ‘বাংলাদেশের জাতিগঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের সৃষ্টি।... আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু করে উনিশশ একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয়কাল পর্যন্ত দীর্ঘ পরিব্যাপ্তির মধ্যে এ-উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাস করা হয়েছে।’

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধান, ইতিহাসের প্রতি অনুসন্ধিৎস্যা, নৃ-তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তার ‘পবিত্র নারীরা’, ‘তৃণভূমি বাইসন’, ‘শুধু তোমাদের জন্য’ উপন্যাসগুলোতেও। এই উপন্যাসগুলো তুলে এনেছে মাতৃতান্ত্রি¿ক আদিম সমাজ, সমাজের বিবতর্ন, ক্রমে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং নারীর ক্ষমতা হারানোর ইতিহাস ও বাস্তবতা।

উপন্যাসের বিষয় নির্বাচনে রিজিয়া রহমান নিজেকে কোনো গ-িতে আবদ্ধ রাখেননি। ইতিহাস, নৃ-তত্ত্ব, বিবর্তন এসবের পাশাপাশি দেহজীবী, শ্রমজীবী, মুক্তিকামী মানুষ, নানা পেশা-শ্রেণির মানুষ, সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, সমাজ ও শ্রেণি-সচেতনতা তার সৃষ্টির মূল অনুষঙ্গ। তার লেখার একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে অন্ত্যজ মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন। তাদের জীবনের আনন্দ বেদনা, হিংস্রতা, ক্লেশ ও জীবন-সংগ্রাম। প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ভাঙা ঘর’ বস্তির মানুষের গল্প। বস্তির মানুষদের কাছ থেকে দেখেছেন। তাদের গল্প শুনেছেন। দেখেছেন তাদের জীবনের ক্লেদ-ক্লান্তি, স্বপ্ন আর স্বপ্ন ভাঙার বেদনা। সেই ক্লেদাক্ত জীবন যন্ত্রণার গল্পই তুলে এনেছেন ‘ঘর ভাঙা ঘর’ উপন্যাসে। সাঁওতালদের নিয়ে লেখা তার উপন্যাস ‘একাল চিরকাল’। এ উপন্যাসে অন্ত্যজ মানুষের জীবনের চিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন তাদের বিবর্তন। এই মানুষগুলো বারবার বদলেছে তাদের পেশা। শিকারি থেকে কৃষক, তারপর আবার কৃষক থেকে খনির শ্রমিক। এই বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাঁওতালদের সংশয়, কুসংস্কার, হিংসা, রক্তারক্তি, সংস্কৃতি আর বেঁচে থাকার কঠিন-সংগ্রামও তুলে এনেছেন অবিকল বিশুদ্ধতায়। এই মানুষরা জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে শিকারি থেকে শ্রমজীবী মানুষে পরিণত হয় কিন্তু তারপরও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না, তারা নতজানু থাকে একমুঠো ভাতের চাহিদার কাছেই। এভাবেই বোধহয় লেখা হয় বঞ্চিত মানুষের ইতিহাস অথবা বোধহয় এটাই বঞ্চিত মানুষের ইতিহাস : ‘প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারের নীলাভ কুয়াশা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে মানুষ হড়। হড়রাই সেই নীলাভ অন্ধকারের পবিত্রতা দুই হাতের মুঠোয় ভরে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। আর অনেক দূর থেকে শংখিনী সাপের আঁকাবাঁকা দেহভঙ্গির কুটিলতা নিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে এগিয়ে আসে সভ্যতা।’ (একাল চিরকাল, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা-৯)

বঞ্চিত মানুষের ইতিহাস ক্ষমতা দখলের নয়, রাজ্য শাসনের নয় বরং পেট পুরে খাওয়ার স্বপ্ন দেখার। ঠিক যেমন তার ‘ইজ্জত’ গল্পে একমুঠো ভাতের জন্য শোনা যায় ক্ষুধার্ত হালিমনের আর্তি : ‘ঘোলাটে পানি আর সিসে রঙের আকাশের চেহারা ভুলে হালিমন ভাবল সানকি ভরা ঝরঝরে ফুরফুরে রৌদ্রোজ্জ্বল এক সানকি ভাতের কথা। সুন্দর সাদা রঙের ভাত। সোনা রঙের ডাল। আর কী? না, আর কিছু না। এক থালা ভাত আর ডাল, এর চেয়ে বেশি বড় কিছু বুঝি এ মুহূর্তে হালিমনের স্বপ্নে আসতে পারে না।’

বেলুচিস্তানের স্বাধীনচেতা মানুষ, তাদের দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ, গৌরব, সাহসের কাহিনি নিয়ে ‘শিলায় শিলায় আগুন’ উপন্যাস। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিলুচিস্তানের বিদ্রোহ ও কালাতের যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। এই উপন্যাসেও আমরা দেখি সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার অধিকারহীন আর শোষিত মানুষের হৃদয়ের আর্তনাদ। বেলুচিস্তানের কাহিনিকে কেন্দ্র উপন্যাসটি লিখলেও তিনি বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষ, তাদের মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার স্বপ্ন আর সাহসকে তুলে এনেছেন শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি আর শৈল্পিক ব্যঞ্জনায়।

বঞ্চিত আর অন্ত্যজ মানুষের আর্তি তার গল্প, উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ হলেও রিজিয়া রহমান সুন্দরের প্রত্যাশী আশাবাদী মানুষ। সেই আশাবাদ দেখা যায় তার ‘বাঘবন্দী’ উপন্যাস। সুন্দরবনের গ্রামাঞ্চলে একটি বাঘ চলে আসা নিয়ে এ উপন্যাসের কাহিনি। উপন্যাসে প্রতীকের আড়লে তুলে এনেছেন মানুষের শঙ্কা ও আশা। নিরাপত্তাহীন মানুষ প্রতিনিয়ত নিঃস্বতা ভয়, ক্ষুধা, মৌলবাদীদের ভয় এসব নিয়ে অস্তিত্ব সংকটহীনতায় ভোগে। এসব মানুষের কাছে বাঘ হয়ে এসে খেয়ে ফেলার ভয় দেখায়, মানুষ ভীত হয়ে পড়ে। ‘বাঘ’ প্রতীকের আড়ালে মানুষের এই শঙ্কা এই ভয়কেই অঙ্কিত করা হয়েছে এ উপন্যাসে। কিন্তু মানুষ সব সময়ই উত্তরণ চায়। দুঃস্বপ্ন নিয়ে পড়ে থাকতে চায় না। এই দুঃসময়কে অতিক্রম করার চেষ্টা ও স্বপ্নকেও তিনি রেখেছেন ‘বাঘবন্দী’ উপন্যাসে। কোনো একজন ফুলরানী এসে বাঘকে বন্দি করে বা কোনো একজন এসে বাঘবন্দি করবেই এই আশায় উজ্জীবিত থাকে মানুষ। স্বপ্নই মানুষরকে বাঁচিয়ে রাখে। দুঃশাসন যন্ত্রণা, নিরাপত্তাহীনতা থেকে এভাবেই মানুষ মুক্তির দিন গোনে। মুক্তির পথ বের করে।

রিজিয়া রহমানের এভাবেই প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার যন্ত্রণা, কষ্ট তাদের প্রতি মুহূর্তের পেষণ, আশা, স্বপ্নকে তুলে ধরেছেন মানবতাবাদ ও আশাবাদের মাধ্যমে। রিজিয়া রহমান জীবনবাদী মানুষ। জীবনের গল্প বলে গেছেন কখনো ইতিহাসের মাটি খুঁড়ে, কখনো প্রান্তিক মানুষের অন্তর্লীন বেদনা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মানুষের বন্দিত্ব, অসহায়ত্ব ক্ষুদ্রত্ব, মহত্ত্ব আর ইতিহাসের নির্মোহ উন্মোচনÑ সবকিছুই প্রকাশ করেছেন জীবন নামক ধোঁয়াশা আর মানবজীবনের সেই শাশ্বত সত্য বেঁচে থাকার ক্লান্তিকর চেষ্টার মধ্য দিয়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অনেকগুলো ক্রান্তিকাল দেখেছেন তিনি, দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, রাজনৈতিক টানাপড়েন। বহমান সময়ের অভিজ্ঞতা ইতিহাসপ্রিয়তা, ব্যাপক পড়াশোনা, মানুষের জীবনপাঠের অভিজ্ঞতা তার সৃষ্টিকে করেছে অতলষ্পর্শী, মানবিক ও লক্ষ্যভেদী। তিনি আর অবিচল সাধনা আর নিষ্ঠা দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে তৈরি করেছেন তার স্বতন্ত্র আসন, ভিন্ন এক কণ্ঠস্বর। যে কণ্ঠ জীবনের জয়গান গেয়ে গেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য খুঁড়ে আর জীবন খুঁড়ে খুঁড়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close