সাজ্জাদ ইসলামের কাব্যের রসায়ন

  ১০ জুলাই, ২০২০

বিমূর্ত ব্যাপারগুলো

কবি সাজ্জাদ ইসলাম একজন ব্যাংকার, চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যে সমঝদার। তিনি পৃথিবী ও প্রকৃতি ভালোবাসেন। নদী ভালোবাসেন। ভালোবাসেন ফুল-পাখি; পাখির অভয়ারণ্য। তবে কবিতা লেখা ও ছবি আঁকাই তার মূল কাজ। অবসরে কবিতা, তেল ও জলরঙে নিজেকে নিমগ্ন রাখেন। চিত্রপটে, কবিতায় তুলে আনেন স্বদেশ ও সমকাল।

বাংলাদেশের চিত্রশিল্প সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও এ বিষয়ে লেখালেখি খুব কম। অপ্রতুল। সাজ্জাদ ইসলামের চিত্রশিল্প নিয়ে কোনো লেখা এ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। তার কবিতায়, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে সমাজের গভীর অবলোকনের নির্যাস খুব স্পষ্ট হয়েই ফুটে উঠেছে। তিনি শিল্পের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছেন বলেই এত নিপুণভাবে, দক্ষ কারিগরের মতো অলঙ্কার-সমৃদ্ধ কবিতা আমাদের উপহার দিতে পেরেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বিমূর্ত ব্যাপারগুলো’।

কবি পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে বড় বেশি উদ্বিগ্ন। চিন্তিত। কখনো কখনো কবির সিম্বল পাখি। এই পাখি কখনো বেগুনি বাতাসে উড়ে বেড়ায়। আবার কখনো চুমু দিয়ে ক্ষত করে, ফুলে ফুলে ছড়ায় কর্কট। আবার এই স্মৃতি-পাখি ডাক দিলে জেগে ওঠে অচেনা-অজানা কোনো এক উন্মাদ, বেকারগ্রস্ত মানুষ। যে বাস-টেম্পো গুঁড়িয়ে ফেলে। ছিঁড়ে ফেলে চন্দ্র-সূর্য। ‘অকারণে বসে থাকে দীঘল রাত্রির নীল বাঁকে’, অথবা ‘অন্ধ সময়ের গোপন কোটরে’। সবশেষে এই পাখিই ‘কত রাজ্য জয় করে ফিরে আসে আপন অন্ধরে, ঘুম যায়, দুধ খায়, শিল্প-আঁকে।’ কবি সাজ্জাদের ‘নীল উপাখ্যান’ একটি সনেট। যার একটা অংশ এই রকমÑ ‘নীল পাখি উড়ে যায় বেগুনি বাতাসে... কত ফলে/চুমু দিয়ে ক্ষত করে, কত ফুলে ছড়ায় কর্কট/জ্যামিতিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কোষে কত শত শোক থাকে/পাখি সেকি তুমি জান, নাকি এটি এক মিছে খেলা?/নীল তুমি মিথ্যা, মায়া-মরীচিকা, তবু বেঁচে আছি!/করি কাজ, দেখি স্বপ্ন, হৃদয়ের বিষের প্রভাবে!’

সাজ্জাদ ইসলামের দেহ থেকে বেরিয়ে আসে নিত্যনতুন গল্প-কবিতা। কবিতার নির্যাস। লাউডগা নতুন ফুলের ঘ্রাণ। তিনি কখনো কখনো দগদগে, ক্ষত-বিক্ষত, উত্তপ্তÑ অগ্নিময় পৃথিবীর নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নিমিষেই। সুর তুলতে পারেন বিষের বাঁশিতে। অগ্নিবীণায়। বাঁশি হাতে নিয়ে কবি তার সুর-ষড়ৈশ্বর্যে, বলিষ্ঠ দেহ-সৌষ্ঠবে সুরের ঝঙ্কার তুলে আলোকিত করেন আমাদের এই ঘুণে ধরা পৃথিবীকে। অর্থাৎ সীমানা পেরিয়ে গন্ধম-সময়ে এক নতুন পৃথিবীর জন্ম দেন সাজ্জাদ ইসলাম। কবি সাজ্জাদের কলম বেশ শক্ত-সামর্থ্যÑ মিসরীয় পিরামিডের মতো মজবুত। তাজমহল অথবা ক্লিউপেট্টার মতো মুগ্ধতা ছড়ায় দশদিকে। দারুণ দিগন্তে। রৌদ্রে... ‘সহ্যের সীমা পেরিয়ে এসে, কফিন নিয়ে, পিরামিড দেখে শস্য আবিষ্কার করেছিল/লবণ স্বাদমতো চিনির সমান তালে এগোয়নি ধরে নিয়ে পিরামিড পর্বতের দক্ষিণে, তৃণাচ্ছন্ন শুষ্ক সমতলে, কোনো হদিস পাওয়া গেল না শব্দবাজির/ফলে, অসাধারণ মুগ্ধতায় ছেয়ে গেছে/আলোকিত কামনা।’

আমি আগেই বলেছি, সাজ্জাদ ইসলাম প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। তার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে প্রেম ও প্রকৃতি। নদীর সঙ্গে তার সখ্য দীঘদিনের। তিনিও নদীতে সাঁতার কাটেন। নায়ে চড়েন। লিখে ফেলেন কবিতা। উজানের আছাড়িপাছাড়ি তমস্যায় সাজ্জাদ ইসলামও নদী হয়ে যান। জল ও তেলরঙে এঁকে ফেলেন সমুদ্রের সফেন ঢেউ। উত্তাল সাগর তার কবিতার বিষয়-আশয়। নদী দেখলে কবি নেমে যান তার জলের বিছানায়। জোয়ার-ভাটায় ডুব দ্যান; সাঁতার কাটেন। ধুয়ে নেন হৃদয়ের গলি-ঘুপছি। নাভি ও নিতম্ব। শরীরের পেলব মাংস।... কবি নদী ও সন্ধ্যার শেষ দিগন্তে কবি খুঁজে পান জীবনের গূঢ় অর্থ। অর্থের অধিক। সৌন্দর্যের ষড়ৈশ্বর্য। সাজ্জাদ ইসলাম তার ‘মহুয়া নদীতে এক সন্ধ্যা’ কবিতায় বলেনÑ ‘আর কি দেখার আছে পৃথিবীতে, মরণের আগে?/জোয়ারের অসহায় ফেনার মুগ্ধতা যে আবেগে/ছুটে চলে সমুদ্রের প্রাচীন জঠরেÑ সে মৌনতা/

থাক, জীবনের এক ধ্রুব প্রয়োজনে, অমূল্য সঞ্চিতা/আজকের অপার্থিব সন্ধ্যা-আলো স্রষ্টার কল্পনা/জীবনের অর্থ আছে? মৃত্যু-সাপ তুলে আছে ফণা।’

কবি সাজ্জাদ শুধু প্রকৃতিপ্রেমীই নন, তিনি একজন প্রেমিক পুরুষও বটে। তার কবিতায় প্রকৃতি ও দ্রোহের সঙ্গে প্রেমও জড়িয়ে আছেÑ দিগন্ত শেষে যেভাবে নদী ও আকাশ জড়িয়ে থাকে। কবিকে ছেড়ে তার ভালোবাসার আর কোথাও যায় না। তার পাশেই বসে থাকে ভালোবাসার একগুচ্ছ রোদ। এখন আর কবির কোনো ভয় নেই। কবিকে তার মানসী দিয়েছে স্তনের ছায়া শীতল শান্তিÑ ‘এখন আমার আর কোনো ভয় নেই/অনায়েসে পার হতে পারি মরু-সাগর-দুর্গম এভারেস্টÑ/আমার কিসের ভয়?/পেয়েছি তোমার ভালোবাসা; মৃত্যুর আগে, তোমার/স্তনের ছায়া শানিত দিয়েছেÑ/এ প্রাপ্তি নিয়ে, বিচূর্ণ সময়গুলো জড়ো করব আবার/হৃদয়ের ভাঁজ খুলে দেখব/সূক্ষ্ম কারুকাজ।’

সাজ্জাদ ইসলামের ‘বিমূর্ত ব্যাপারগুলো’ কাব্যগ্রন্থের কোথাও কোনো অযাচিত শব্দ ও বাক্য নেই। বইয়ের প্রচ্ছদ, গেটআপ-মেকআপ সবটাতেই চোখের প্রচ- দ্যুতি আছে। আছে কাব্যের বিমূর্ত রসায়ন। কিন্তু বইটিতে কিছু বানান বিভ্রাট আছে। এ দোষ কবির নয়, প্রকাশকের।

বইটির প্রকাশক জিনিয়াস পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ করেছেন সাজ্জাদ ইসলাম নিজেই। দাম ২০০ টাকা।

* মৃধা আলাউদ্দিন

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close