তৃপ্তিকর প্রসন্ন জীবন

  ১০ জুলাই, ২০২০

অতন্দ্রিলা

ঘুমাওনি জানি

অতন্দ্রিলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন কবি, সে স্বপ্ন বড় হয়, বাঁক নেয়, বেহুলা ভাসান নিয়ে ঘাটে ঘাটে ফেরি করে অনাদি সময়। সেই সময়কে কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী তুলিতে-রঙে, মননশীলতায় অদ্বিতীয় ভাষাবিবৃতি রচনা করেছেন ‘অতন্দ্রিলা ঘুমাওনি জানি’ কাব্যগ্রন্থে।

‘কবি যাহা দিতেছেন, তাহাই গ্রহণ করিবার জন্য পাঠককে প্রস্তÍত হওয়া উচিত; পাঠক যাহা চান, তাহাই কাব্য হইতে আদায় করিবার চেষ্টা করিতে গেলে অধিকাংশ সময়ে নিরাশ হইতে হয়। তাহার ফল হয়, যাহা চাই তাহা পাই না এবং কবি যাহা দিতেছেন তাহা হইতেও বঞ্চিত হইতে হয়।’ রবীন্দ্রনাথের এ মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা এখনো যে আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে কোনো কবির কবিতায় যদি রসনিষ্পত্তিতে ঘাটতি না পড়ে, তাহলে পাঠক হিসেবে কিছু বলার থাকার কথা নয়। আলমগীর রেজা চৌধুরী ঠিক সে ধরনের একজন কবি। তার কবিতায় পাঠক খুঁজে পায় বৃষ্টির ধারা, পিপাসিত জল।

‘অতন্দ্রিলা ঘুমাওনি জানি’ পুরো গ্রন্থটি একটি কবিতা, একটি কবিতার শরীরজুড়ে শুয়ে আছে অতন্দ্রিলা নামের এক পুষ্পিত নারী, যাকে কবি ছাব্বিশ খন্ডে গ্রন্থিত করেছেন এবং পাঠান্তে কবি পাঠককে যে অনুভবের মধ্যে পৌঁছে দেন, সেখানে সমগ্র পৃথিবী, প্রকৃতি, প্রেম একাকার হয়ে ওঠে বিমূর্তভাবে।

এটি একটি কবিতার বই হলেও স্বাদে-গন্ধে-মেজাজে একটি গল্প এবং চরিত্রগুলো আমাদের খুব চেনা, কখনো পড়শি, কখনো সহযাত্রী।

কবি এ গ্রন্থে যেসব চিত্রকল্প ও প্রতীক ব্যবহার করেছেন তা পাঠককে মনে করিয়ে দেয়, কবির দায় বাস্তব চিত্রটিকে তুলে এনে কবিতার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া শুধু নয়, কবিকে হয়ে উঠতে হয় প্রাথমিকভাবে চিত্রকর এবং চিত্রটিকে এমনভাবে সাজাতে হয় বা আঁকতে হয়; যাতে পাঠকের মনে একটা অনুভূতি বা ভাবনার সঞ্চার হয় এবং পাঠক যেন গোটা বিষয় সেই অনুভূতি বা ভাবনার আলোয় নতুন করে দেখতে পায়। এ বিষয়গুলো সামনে রেখেই আলমগীর রেজা চৌধুরী তার কবিতা শরীর তৈরি করেন। যেমনÑ ‘উত্তাল তরঙ্গমালায় হাবুডুবু কাতর ডলফিন/কেবলি তটরেখা ভুল করে/জন্মের ধূসর ছাই মাখামাখি দুঃখী শিশু/ক্রমান্বয়ে লক্ষ্যভেদী অর্জন/নারীকে চিনি, চিনে রেখেছে ট্রয়ের বিরান মাঠ/তবু রজনী লোভী করে তোলে/অতন্দ্রিলা স্পর্শ করো না।’

এ গ্রন্থে আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, প্রতিটি কবিতার শেষে অতন্দ্রিলা অর্থাৎ নারীর নানারূপ উপসংহারে থাকায় কবিতার প্রকৃতি ও নির্যাস বুঝতে সুবিধা হয় পাঠকের এবং বইটিও বুঝিয়ে দেয়, এটিকে বিশেষ গবেষণাগ্রন্থের মতো করে লেখা হয়েছে। এখানে কবি নারীর ভাবমূর্তিকে তুলে ধরেছেন পৌরাণিক সংকেতের নিরিখে, কখনো রাজনীতি প্রেক্ষাপটে, কখনোবা প্রেমময়তায় আলোকদীপ্ত করে। এতে করে পাঠককে নির্মোহভাবে আত্মিক গভীরতায় টেনে নিয়ে যায় প্রথম স্তবক থেকে শেষ স্তবক অবধি।

প্রেম ছাড়া কোনো কবিতার উৎসারণ সম্ভব নয়। এ যদি সত্য হয়, তাহলে কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী এ থেকে দূরে থাকবেন কেন? তাইতো তিনি লেখেনÑ ‘অজানা স্পর্শে চলে অনুকায়, রক্তে মাতম ছিল/তারপর তোমার বুকে হাত দিয়ে দেখি/এইখানে ভালোবাসা আছে কিনা/অতন্দ্রিলা দিঘির মতো চোখে মায়া জড়িয়ে বলে,/তোমার জন্যই/অর্জন আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে আবিষ্কার করে/চিরন্তন এক জীবনকথা/বাসযোগ্য পৃথিবীর কথা (কবিতা ২৪, পৃষ্ঠা ৫১)।’ এখানে তার কাব্যোপলব্ধিতে নারী ও প্রকৃতি একটি অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। নারী অর্থে কবি এখানে স্বদেশকেও অনুভব করেছেন। তাইতো তার কবিতার কেন্দ্রগত বিন্দু এই স্বদেশ ও প্রেম।

কবিমাত্রই প্রেমময়। মায়াময়। যা তার কবিতায় উঠে আসে। কিন্তু আলমগীর রেজা চৌধুরী কবিতায় তথাকথিত আগলা প্রেম নেই। দেহজ প্রেমের কোনো ব্যাপার নেই। আছে ভেতর থেকে উঠে আসা আকুতি। বোশেখ মাসের তৃষ্ণা। শরতের শুভ্রতা।

বইটি প্রকাশ করেছে মেঘ। প্রচ্ছদ করেছেন উত্তম সেন। দাম ১৬০ টাকা।

* সৈয়দ নূরুল আলম

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close