আফরোজা পারভীন

  ১০ জুলাই, ২০২০

স্মরণে বরণে আল মাহমুদ

কবি আল মাহমুদ লোকান্তরিত হয়েছেন ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। শেষ কটা বছর বারবারই মনে হয়েছে তিনি চলে যাবেন, কিন্তু ফিরে এসেছেন তার কবিতার মতোই অমিত শক্তিতে। অফুরান প্রাণশক্তি ছিল তার। সেই শক্তিই বারবার ফিরিয়ে আনত তাকে। কিন্তু শেষবার সে শক্তি আর ধরে রাখতে পারলেন না। ‘প্রকৃতি’ আমরা যাকে বলি অথবা ‘বাস্তবতা’ কিংবা ‘নিয়তি’ তার নামের সঙ্গে যোগ করল ‘মৃত’ শব্দটি। আসলেই কি তিনি মৃত!

‘আম্মা বলেন পড়রে সোনা/আব্বা বলেন, মন দে;/পাঠে আমার মন বসে না/কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।’ এ কবিতা দিয়েই আমার শুরু। আমাদের সময়ের এমন কোনো শিশু-কিশোর নেই যে এ কবিতা পড়েনি। তারপর একে একে হাতে এলো ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’ ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো।’ গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ পড়ে নির্ঘুম রাত কাটালাম। ‘সোনালী কাবিনে’-এর সনেটগুলো আমার অবচেতনে স্থায়ী হয়ে গেল।

আবেগ না থাকলে কবিতা হয় না। কিন্তু সে আবেগ হতে হবে সংহত। অতি আবেগ কবিতাকে জোলো করে ফেলে, হারিয়ে যায় কবিতার বলবার কথা। আল মাহমুদের কবিতায় আমরা পাই লোকজ শব্দ, গ্রামীণ পটভূমি, রূপাত্মক শব্দ প্রয়োগ, উপমা, ইতিহাস, এতিহ্য, ইতিহাসের বহমানতা। নাগরিকতার সঙ্গে লোকজ উপাদানের মিশেল দিয়ে তিনি কবিতাকে নিয়ে গেছেন শীর্ষমাত্রায়। তার কবিতা আমাদের অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, গন্ধের সুবাসে আমোদিত হই আমরা। কাঁঠালপাতার গন্ধ কিন্তু সত্যিই পাই আমরা। সত্যিই পাঠে মন বসে না। তার কবিতা একাধারে আমাদের রসনা ও স্বাদ মেটায়।

আল মাহমুদ দুর্বোধ্য কবি নন। অনায়াস, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা তার কবিতা। পাঠকের বুঝতে সমস্যা হয় না। সহজে স্বাচ্ছন্দ্যে কবিতার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, করতে পারে কবিতার রসাস্বাদন। যে কবিতায় পাঠক নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারে না, সে কবির মৃত্যু ঘটে। কারণ কবিতাই পাঠকমনে কবির বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তাই বলে তিনি কিন্তু কোনো গতানুগতিক কবি নন। তার যে সহজিয়া ভাব বা শব্দ, সেটি বোধ্য কিন্তু ব্যতিক্রমী। তার কবিতায় আমরা পাই প্রকৃতি। পাই ফুল, পাখি, নদী, চাঁদ, ঝর্ণা, অঢেল সৌন্দর্যের পৃথিবী। পাই লাবণ্যবতী রমণীর পুরো শরীর। বক্ষ, কেশ, আঁখি, মুখ। অনেক রমণী তার কবি মনকে নাড়া দিয়েছেন। সে রমণীরা তাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিয়েছেন। শরীরী প্রেমের ব্যাপারেও তিনি অকপট, কোনো রাখঘাট নেই। কামনার জোয়ারকে তিনি বাধা দেননি, উসকে দিয়েছেন প্রবাহমানতাকে। বুঝিয়েছেন এর স্বাভাবিকতা। প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে শব্দকে সাজিয়েছেন। আদিমতাকে চিত্রায়ণ করেছেন অপূর্ব নান্দনিকতায় : ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি,/আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি/আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,/ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি;’ এভাবেই ‘সোনালী কাবিনে’-এর সনেটগুলোতে উপমা আর রূপকে নারীর প্রতি পুরুষের অদম্য আকাক্সক্ষা ও কামনার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি অক্লেশে, অপার সুষমায়।

আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও গল্প উপন্যাস ও আত্মজীবনী লিখেছেন। লিখেছেন শিশুতোষ গল্প কবিতা ছড়া। কবিতার মতো গদ্যেও তিনি অনায়াস, সাবলীল। তার গদ্য ঝরঝরে কিন্তু বেগবান। সে বেগ কখনই হোঁচট খাওয়ায় না। তার গদ্য পাঠককে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। আগেই বলেছি, তার লেখায় উঠে এসেছে ইতিহাস। ‘সোনালী কাবিন’সহ অন্যান্য গ্রন্থে তিনি ইতিহাস তুলে এনেছেন। তার নজর এড়ায়নি সমকালও। জীবনের এক পর্যায়ে কবি ইসলামী ভাবধারার কিছু রচনা লিখে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু তাতে কি ঢাকা পড়েছে তার ‘সোনালী কাবিন’?

আল মাহমুদ আধুনিকতায় লোকজ উপাদান উদার হাতে মিলিয়ে দিয়ে বহুল আলোচিত হয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তরে’, ‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন’, ‘এমন তৃপ্তির’, ‘নৌকোয়’ ইত্যাদি কবিতায় গ্রামীণ ঐতিহ্যলগ্নতার যে উদ্ভাস ছিল, তা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কলস’ এবং বিশেষ করে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিনে’ এসে বিচ্ছুরিত হয়।

‘কালের কলস’ ও ‘সোনালী কাবিনের’ অনেক কবিতার গ্রামীণ জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হঠাৎ ‘নাগরিক’ বনে যাওয়া মানুষের জন্য কবির আক্ষেপের প্রকাশ দেখি। ‘কালের কলসে’ ‘জল দেখে ভয় লাগে’, ‘ফেরার পিপাসা’, ‘হে আচ্ছন্ন নগরী’, ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে এ আক্ষেপ : ‘দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মতো ঘরবাড়ি, নারী/উঠোনে ঝারছে ধান, ধানের ধুলোয় মøান শাড়ি;/গতর উদোম করে হাতে লেপা মাটির চত্বরে/লাঞ্ছিত নিশেন হয়ে পড়ে আছে যেন অনাদরে।’

‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতায় আমরা দেখি, গ্রামের একদল মানুষ (কবির ভাষায় ‘শস্যের শিল্পীরা’) খেতের আলে বসে তামাক সাজাচ্ছে। শহর থেকে আগত এক বালকের উদ্দেশে ‘একগাদা বিচালি বিছিয়ে দিতে দিতে’ তাদের সঙ্গে বসার আহ্বান জানাচ্ছে তারা। কিন্তু ‘নগরের নিভাঁজ পোশাক খামছে ধরেছে (বালকের) হাঁটু’, তাই সে কিছুতেই দেশের মাটির বুকে অনায়াসে বসতে পারছে না অথচ এই বালকের ‘বাপের মারফতির টান শুনে বাতাস বেহুঁশ হয়ে যেত’। আল মাহমুদ এ-কবিতার এক স্থানে বালককে উদ্দেশ করে বলেন : ‘তোমাকে বসতে হবে এখানেই,/এই ঠান্ডা ধানের বাতাসে।/আদরে এগিয়ে দেওয়া হুঁকোটাতে সুখটান মেরে/তাদের জানাতে হবে কুহলি পাখির পিছু পিছু/কতদূর গিয়েছিলে পার হয়ে পানের বরোজ!’

‘সোনালী কাবিন’ অভিন্ন শিরোনামের ১৪টি সনেট। এর বিষয়বস্তু বহুমাত্রিক। বাঙালি সমাজের নানা অনুষঙ্গ, মিথ ও সাহিত্য-ঐতিহ্য, প্রাচীন বঙ্গভূমির সমাজব্যবস্থা, বাঙালি-সমাজের অসংহতিসমূহ থেকে শুরু করে ফসলের সুষম বণ্টন অর্থাৎ সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনাও স্থান পেয়েছে সনেটগুলোতে। রয়েছে নরনারীর যৌন বাস্তব ছবি। শরীরী প্রেমের এমন খোলামেলা প্রকাশ বাংলা কবিতায় তেমন চোখে পড়ে না : ‘বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল/পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না;/তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিয়ো সেই ফল/জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে হবো চিরচেনা।’ ‘চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ/ঈগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়।’ ‘বাঙালি কৌমের কেলি কলো¬লিত কর কলাবতী/জানত না যা বাৎস্যায়ন আর যত আর্যের যুবতী।’

তিনি চলে গেছেন, রেখে গেছেন কালজয়ী কীর্তি। তিনি একবার লিখেছিলেন : ‘আমি লেখক হওয়ার, কবি হওয়ার মোহে দৃঢ় বাসনা পোষণ করতাম, আর লোকে তো এখন আমাকে কবিই বলে।... আমি কবিতা লিখেছি, গল্প-উপন্যাসও লিখেছি। সব মিলিয়ে সমালোচকরা এক দিন আমার বিচার করবে। আশা করি, আমি সুবিচার পাব।’

তিনি কবে সুবিচার পাবেন বা আদৌও সুবিচার পাবেন কি না জানি না। মনে পড়ে ২০০১ সালে রাজধানী এক্সপ্রেসে কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছিলাম। পাশের সিটে বসা এক যুবক। কথা শুরু হলো ইংরেজিতে। একসময় বুঝলাম দুজনই বাঙালি। নাম অমর চক্রবর্তী। কবিতা লেখেন। আমার পরিচয় জেনে উচ্ছ্বসিত। বললেন, মাহমুদকে চেনেন? বললাম, কোন মাহমুদ? তিনি কিছুটা বিরক্ত হলেন, খানিকটা যেন আশাভঙ্গও। বললেন, লেখালিখির জগতের মানুষ মাহমুদকে চেনেন না? মনে হলো, আমি সত্যিই লিখি কি নাÑ এটা নিয়ে তিনি দ্বিধান্বিত। বললাম, শুধু মাহমুদ বললে হবে কী করে, আগে পরে তো কিছু আছে? তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, সব মানুষের নামের আগে পরে লাগে না। দুই বাংলার সেরা কবি, ‘সোনালী কাবিনে’-এর কবি মাহমুদের নামের আগে পরে লাগে না। এক দিন একটা অনুষ্ঠানে কবির সামনে কথাগুলো বলেছিলাম। সেদিন কবি খুব খুশি হয়ে গালভরে হেসেছিলেন। মনে হয়েছিল, চারধার ভেসে গেল কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close