জান্নাতুন নিসা

  ০৩ জুলাই, ২০২০

নিমাই ভট্টাচার্যের গদ্যে বিষয় বৈচিত্র্য

নিমাই ভট্টাচার্য তার লেখনীর প্রতিমুঠো চন্দ্রকলার হাতছানিতে দীর্ঘকালব্যাপী আঁচল খসা বাঙালির আধভাঙা আকাক্সক্ষায় বয়ে চলা সাহিত্যের তীব্র ক্ষুধা মিটিয়েছেন। আর মানব মনের শাশ্বত প্রেমসত্তাকে দিগন্ত প্রসারিত ঘনিষ্ঠ বিচিত্রতায় কিংবা সুপ্ত নাচঘর পেরোনো সৌন্দর্যে পাঠককে করেছেন মোহাবিষ্ট। কেবল তাই নয়, ট্রেনের কামরায় চুপিচুপি স্থির হওয়া দুটি প্রাণীর ঈষৎ দোলায়িত চার চোখের উন্মুক্ত চোরা চাহনির তির্যক মিলন যে ইতিহাসের সূচনা করেছিল, তার সঙ্গে তিনি জীবনের বৈদূর্যমণি জ্বেলে অতি সন্তর্পণে যোগ করেছিলেন এক আকাশ সাহস, নিষ্ঠা আর বিশ্বাস। জীবন নদীর আগুনধোয়া জলের খোঁপায় সাংবাদিকতাকে ছাপিয়ে সাহিত্যচর্চায় মগ্ন হয়েছিলেন নিলীমামথিত আকাশের দুয়ার খুলে। আর শেষযাত্রা পর্যন্ত রক্তজবার উদগ্রীব ছায়ায় ভর করে শূন্য ভুবনের অসীমতায়; অবাক বাঁশির ভাঙনের সুরে গিঁটবাঁধা জানালার হাত ধরে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন তুলতুলে প্রেমের অঙ্কুরিত স্বপ্নে ঘেরা শুভ্র চাঁদের উচ্ছ্বলিত স্পর্শ। তাই বুঝি, তার প্রতিটি গদ্যের শরীর বেয়ে ফুটে উঠেছে আলো-আঁধারের বিষয়গত বৈচিত্র্যতার প্রস্ফুটিত ছাপ।

রৌদ্রক্লান্ত জলছাপের দীর্ঘ আলিঙ্গনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বাংলা সাহিত্যের কথাসাহিত্যিক এবং বরেণ্য সাংবাদিক নিমাই ভট্টাচার্য সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং শৈলবালা ভট্টাচার্যের ঘর আলো করে ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের বৃহত্তর যশোরের (বর্তমানে মাগুরা) শালিখা উপজেলাধীন শরশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন, পরে দেশভাগের কারণে বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন এবং আমৃত্যু পশ্চিমবঙ্গেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। দিল্লিতে প্রায় ত্রিশ বছর সাংবাদিকতা করলেও কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসাতেই শেষ জীবন কাটিয়েছেন। রবীন্দ্র-পরবর্তী চাঁদের আগুনে জ্বলে ওঠা সাহিত্যিকদের মধ্যে নিমাই ভট্টাচার্য নিঃসন্দেহে এমন একজন সাহিত্যিক, যিনি তার লেখনীতে কেবল সবুজ ছন্দের অবুঝ ভালোবাসার নিখুঁত চিত্রন প্রকাশ করেননি বরং সবকিছু পাওয়ার পরেও ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর নিদারুণ চিত্র প্রকাশ করেছেন অক্ষয় তারার প্রার্থিত সুন্দরে।

নিমাই ভট্টাচার্য জীবনের কল্পলোকে নিঃসঙ্গ হিংস্রতার অভিমান ফুটিয়ে তুলেছেন তার লেখনীতে। ১৯৬৩ সালে তার লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের কাছে তা ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানীর নেপথ্যে’, ‘রিপোর্টার’, ‘ভিআইপি’ এবং ‘পার্লামেন্ট স্ট্রিট’ উপন্যাস একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি পূর্ণোদ্যমে উপন্যাস লেখা শুরু করেন তিনি। আর পাঠকও ভালোবেসে তার লেখনীকে কাছে টেনে নেন, পাঠকের সঙ্গে তিনিও অকপটে লেনদেন করেন তার হাসি-কান্না, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা। তাতে করে সুবিশাল সাহিত্যকীর্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তার সুদীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য সাংবাদিক জীবন। জীবনকে তিনি সাহিত্যের যোগ্য উপজীব্য করে তুলেছেন তার লেখনীতে। অথচ মিষ্টভাষী, সদালাপী ও রসিক নিমাই ভট্টাচার্যের দরাজ গলায় স্পষ্ট কথা; তার লেখনীর কোনো অংশেই তার ব্যক্তিজীবনের ছোঁয়া নেই। পাঠক যা খুঁজে পায় তাই-ই তার সুখের পিপাসায় পরম প্রাপ্তি।

তার প্রথম গ্রন্থ ‘রাজধানীর নেপথ্যে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৮ সালে ‘মেমসাহেব’ প্রকাশ পেতেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া অনেক পাঠকই জেনে-বুঝে কিংবা কারো কাছ থেকে শুনে কোনো সাহিত্যামোদী বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে কিংবা লুকিয়ে বাসায় এনে নিমাইয়ের বিখ্যাত ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসটি পড়েছেন। আর বব কাট চুলে, ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক দেওয়া কোনো ইংরেজ মেমসাহেব নয়, রীতিমতো শাড়ি পরা এক বাঙালি মেমসাহেব যার প্রেমচঞ্চলা-কাজল কালো চোখের গহিনতায় নিজের অজান্তেই আশাহীন জীবনের বিয়োগ-ব্যথায় গোপনে অশ্রু ঝরিয়েছেন। উপন্যাসটি একসময় বইয়ের দোকান ছাড়াও বাসে, ট্রেনে, স্টেশনে, রাস্তায়, যুবক-যুবতীদের হাতে হাতে পাওয়া যেত। ‘মেমসাহেব’ মূলত দোলা বৌদির কাছে লেখা একটি সাধারণ ব্যক্তিগত চিঠি। অথচ চিঠিরূপে কেবল একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ২০৭ পাতায় ভর করে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাহিত্যাবেদনে পাঠকমনে চির তরুণরূপে স্থির থাকা কেবল কঠিনই নয়, রীতিমতো দুরূহ একটি কাজ। যা সফলভাবেই সম্পন্ন করেছেন নিমাই ভট্টাচার্য।

‘মেমসাহেব’ প্রকাশের পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নেন। লেখালেখির জীবনে প্রায় ১৫০টি প্রকাশিত বই রয়েছে তার। ‘মেমসাহেব’, ‘এডিসি’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘গোধূলিয়া’ একের পর এক উপন্যাসে একসময় তিনি বাঙালি অন্দরমহলকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৭২ সালে তার উপন্যাস থেকেই নির্মিত হয় পিনাকী মুখোপাধ্যায় পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মেমসাহেব’। উত্তম কুমার, অপর্ণা সেন অভিনীত সেই চলচ্চিত্র আজও বাংলা সিনেমার রোমান্টিক পর্বের মাইলফলক। ‘মেমসাহেব’ ছাড়াও তার একাধিক উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপ পেয়েছে। উপন্যাস, ছোটগল্পের বাইরে নিমাই লিখেছেন ‘বিপ্লবী বিবেকানন্দ’-এর মতো বইও।

ভারতের কলকাতা রাজ্য সরকারের বঙ্গবিভূষণ সম্মানসহ জীবদ্দশায় সাহিত্যকর্মের জন্য অসংখ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন নিমাই ভট্টাচার্য। বাংলায় ‘জনপ্রিয় লেখক’ বলতে যা বোঝায়, আক্ষরিক অর্থে তিনি ছিলেন তাই। নিমাইয়ের বেশির ভাগ লেখনীতে মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের পদচারণা লক্ষ করা গেছে; অনেকটা ঢেউ ভেঙে আছড়ে পড়া পাথর-কুড়োনির মতো। সাধারণত নায়ক-নায়িকার মিলন অথবা বিরহেই রোমান্টিক উপন্যাস পরিণতির মুখ দেখে, যেখানে উভয়ের বাহুবন্ধনে পৌঁছানোর সাফল্য-ব্যর্থতাতেই কাহিনির সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। কিন্তু তার রোমান্টিক উপন্যাসে মিলন বা বিরহকে ছাপিয়ে একটি সত্য বরাবরই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আর তা হলোÑ সাহস, নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সঙ্গে ভালোবাসার সর্বোচ্চ পরিমাণ উপস্থিতি। তাই হয়তো আমরা দেখতে পাই, চন্দ্রবিরল জ্যোৎস্নায়ও তার উপন্যাসের মেঘমল্লার পেরোনো রোমান্টিক সংলাপগুলো একসময় তরুণ-তরুণীদের প্রেমপত্রের লাইন হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তাদের প্রেমময় আকাশে। তবে তরুণ হৃদয়জয়ী জনপ্রিয় এ সাহিত্যিক বরাবরই সাদামাটা ভাষায় অগ্নি-উত্তাপে স্নিগ্ধ শিষ ছড়িয়ে কথা বলেছেন উপন্যাসে এবং সাদাসিধেভাবে অন্ধকার গলি পার করে গভীর জ্ঞানের, অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন গাছবন্দি ফুলের প্রেমোত্তাল পৃথিবীর দীর্ঘ ধ্যানে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close