পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

  ২৬ জুন, ২০২০

জলধি

পাঠশৈল্যবিদ্যার নতুন দিগন্ত

সাহিত্যের সমৃদ্ধ বিকাশে নির্মোহ আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। মন্দ হোক বা উৎকৃষ্ট হোক, আলোচনাই সাহিত্যকে পাঠকের বৃহত্তর পরিমন্ডলে সঞ্চারিত করে। বোদ্ধা পাঠক কোনো সৃজন-মননশস্যকে পাঠ শেষে কেবল নিজের অন্তরে ধারণ করে গোপন কুঠুরিতে রেখে দিলে, তাতে হয়তোবা ব্যক্তি পাঠকের লাভ হতে পারে। কিন্তু সাহিত্য ও পাঠক সমাজের তাতে তিল পরিমাণ লাভের সম্ভাবনা থাকে না। সাহিত্যকে শানিত করতে তাই মনের গহিনে কবাট মেরে নয়, বরং পাঠ হতে লব্ধ নির্যাসটুকুন ছড়িয়ে দিতে হয় আমপাঠকের দরবারে। তাতেই সাহিত্য পায় সার্থকতা এবং সবলতা। নির্মোহভাবে এ কাজ করা কঠিন বটে। তবু কাউকে না কাউকে এগিয়ে এসে সেই দুরূহ কাজকে কাঁধে নিতে হয়। শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির মুখ-আয়না ‘জলধি’ জলে জোছনায় জীবনের আবাহনের পূতঃমন্ত্র অন্তরে ধারণ করে দুপার বাংলার বইয়ের নির্বাচিত পাঠ-পর্যালোচনায় দৃঢ় এক পদক্ষেপ নিয়েছে ‘জলধি’ সম্পাদক কবি নাহিদা আশরাফীর পৌরহিত্যে, যা আলোর মুখ দেখেছে সুঠাম কলেবরে আগস্ট দুহাজার ঊনিশ সালের তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যার মাধ্যমে।

সাহিত্যে আলোচনা ও পর্যালোচনায় দারিদ্র্যের বিষয়ে সম্পাদক নিজে তার মত ব্যক্ত করেছেন ‘জলধিকথা’-এর মাধ্যমে, যাতে তিনি মনে করেনÑ পাঠ বিশ্লেষণী জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব, পাঠ অভিজ্ঞতার সুচারু ও সাবলীল প্রকাশে অক্ষমতা, পাঠ পর্যালোচনার উপযোগী ও প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞানের অভাব এবং বিশ্বসাহিত্যের প্রতি পাঠ পর্যালোচকের উদাসীনতা ও পাঠের সীমাবদ্ধতাই পাঠ-ব্যবচ্ছেদবিদ্যার বিকাশহীনতার মূল কারণ। সম্পাদকের মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করে তাকে আরো একটু বিস্তৃতি দিয়ে বলা যায়, পাছে লোকে কিছু বলে তথা পাঠ-ব্যবচ্ছেদের পরবর্তী অপ্রীতিকর মন্তব্যাদির বিষয়ে অগ্রিম সংবেদন প্রদর্শন এবং নির্মোহ পাঠ-পর্যালোচনায় চোখের লজ্জায় ব্যর্থ হয়ে স্তুতিতে পরিণতকরণের আশঙ্কাও এ বিষয়ে পশ্চাৎপদতার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কারণ বলে বিবেচ্য হতে পারে।

তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে অমর একুশের বইমেলা ২০১৯-এ বাংলাদেশে প্রকাশিত বইসমূহ কলকাতার লেখক-সমালোচকদের হাতে এবং কলকাতায় প্রকাশিত বইসমূহ বাংলাদেশের লেখক-সমালোচকদের হাতে তুলে দিয়ে পাঠ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের জন্য এক নান্দনিক মঞ্চ তৈরি করা হলো ‘জলধি’র সৌজন্যে। বাংলা ভাষার জন্মভূমিতে সাহিত্যকে সীমানাহীন করে তোলার মহৎ অভিপ্রায়ে ‘জলধি’র এই কর্মযজ্ঞ কতটুকু সফল হয়েছে, তা নির্ণয় করবে অনাগত সময়। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই আয়োজন আমাদের একটা দূরগামী পথের সন্ধান দিয়েছে, যার শেষ বিন্দুতে সুন্দরের প্রণম্য সরোবর অপেক্ষা করে আছে।

হারকিউলিসের বলে বলীয়ান হয়ে ‘জলধি’ যে দক্ষযজ্ঞে নেমেছে, তাতে বাংলাদেশ ও কলকাতার কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ সংগ্রহ, অনুবাদ-সাহিত্য, সাহিত্যের ছোটকাগজÑ এসব কিছুই স্থান পেয়েছে চারশ পৃষ্ঠার অবয়বে, যা পেতে পাঠকের আর্থিক বিনিয়োগ ধার্য হয়েছে মাত্র পাঁচশ টাকা। সুন্দর ছাপা, চমৎকার নামলিপি এবং প্রায় বিজ্ঞাপনী দৌরাত্ম্যমুক্ত, রূপে-রসে ‘জলধি’ পেয়েছে অনাবিল সার্থকতা।

এ সংখ্যায় বাংলাদেশের পর্যালোচিত কবিতার বইগুলো হলোÑ অজিতেশ নাগের আলোচনায় হুজাইফা মাহমুদের ‘অন্তস্থ ছায়ার দিকে’, অনিন্দিতা বসু স্যানালের আলোচনায় ফারুক ওয়াসিফের ‘তমোহা পাথর’, অরুণ কান্তি ভট্টাচার্যের আলোচনায় শুভ্র সরকারের ‘ঈর্ষার পাশে তুমিও জুঁইফুল’, তাপস রায়ের আলোচনায় মাসুম মুনাওয়ারের ‘সূর্যোদয়ের দৃশ্যাবলি’, দেবযানী বসুর আলোচনায় মাসুদার রহমানের ‘কামরাঙাগাছটি রাজি হচ্ছে না’, প্রদীপ্ত গুপ্তের আলোচনায় তানিম ইশতিয়াকের ‘বুকের জলে বুদবুদ’, বিমল পন্ডিতের আলোচনায় গৌরাঙ্গ মোহান্তের ‘প্রমগ্ন কবিতাবলি’, রবীন বসুর আলোচনায় মেহেরুন নেসার ‘শ্রাবণ বাঁশি’, শানু চৌধুরীর আলোচনায় মাহমুদ নোমানের ‘লুইজালে’, সোনালী দত্তের আলোচনায় বিমল গুহের ‘ও প্রেম ও জলতরঙ্গ’ এবং সৌমেন চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনায় মাসুদ খানের ‘পাখি তীর্থ দিনে’।

এর সমান্তরালে কলকাতার কবিদের লিখিত যে বইগুলো পাঠ-পর্যালোচিত হয়েছে তার মধ্যে কমলকলি চৌধুরীর আলোচনায় সঞ্জয় ঋষির ‘বটফলের কবিতা’, খসরু পারভেজের শব্দব্যবচ্ছেদে নৃপেন চক্রবর্তীর ‘মেটারনিটি লিভ ও ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণ পরিচয়’, গৌরাঙ্গ মোহান্তর আলোচনায় সোমনাথ বেনিয়ার ‘ব্যক্তিগত ধূসর’, ঝর্ণা রহমানের আলোচনায় রবীন বসুর ‘জন্মের প্রবাহিত ঋণ’, ফারুক সুমনের আলোচনায় ‘১৪৪ ধারা অরিজিৎ বাগচী’, মারুফ ইসলামের আলোচনায় দীপশিখা চক্রবর্তীর ‘নৌকাজন্ম’, মাহমুদ নোমানের আলোচনায় ‘মহিরুহের ভালোবাসায়’, শহীদ ইকবালের আলোচনায় প্রবাল কুমার বসুর ‘বালিতে জলের দাগ’, সরোজ মোস্তফা ব্যবচ্ছদকৃত ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্যের ‘কিছু নতুন পুরোনো জলছবি’, সাকিরা পারভীনের আলোচনায় অনিমিখ পাত্রের ‘আলো দেখার নেশা’, হাসান জামিলের আলোচনায় সঙ্ঘমিত্রা হালদারের ‘একা এক উহ্য মুদ্রা’Ñ এই কাব্যগ্রন্থগুলো উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশি গল্পকারদের বইগুলোর মধ্যে আলোচিত হয়েছেÑ সুবন্ত যায়েদের ‘কতিপয় মৃত্যুপ্রকল্পের প্রাণ’ আলোচক অমিত গোস্বামী, নাহিদা নাহিদের ‘পুরুষপাঠ’ আলোচক ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, রেজওয়ান তানিমের ‘অসুখগুলো প্রাপ্তবয়স্ক’ আলোচক গৌতম বিশ্বাস, খালিদ মারুফের ‘সাপ ও শাপ-সংক্রান্ত গল্পগুলি’ আলোচক দীপা চৌধুরী, হামিম কামালের ‘সোনাইবলের বনে’ আলোচক শান্তনু ভট্টাচার্য এবং সানোয়ার রাসেলের ‘প্রায় সব চরিত্র কাল্পনিক’ আলোচক সৌরভ চক্রবর্তী। গল্পে কলকাতা অংশে আলোচিত বইগুলো হলোÑ সায়ন্তনী ভট্টাচার্যের ‘ম্যাজিক ছাতা ও আরো ৯’ আলোচক মিলু হাসান, শান্তনু ভট্টাচার্যের ‘তরঙ্গনগর’ আলোচক মেহেদী ধ্রুব, কৃষ্ণেন্দু মজুমদারের ‘চিলেকোঠায় রোদ্দুর’ আলোচক রেদওয়ান খান, সুদেষ্ণা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছাতিমের গন্ধ’ আলোচক ড. শামস্ আলদীন, নীহারুল ইসলামের ‘জমিন আসমান’ আলোচক সানোয়ার রাসেল এবং হামিরউদ্দিন মিদ্যার ‘আজরাইলের ডাক’ আলোচক সোলায়মান সুমন।

কথাসাহিত্যের বিস্তৃতধারা তথা উপন্যাসের আলোচনায় বাংলাদেশের অংশে স্বকৃত নোমানের ‘মায়ামুকুট’ গল্পে গতানুগতিকতার বাইরে নতুন কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ ফুটে উঠেছে আলোচক রাজু বিশ্বাসের বয়ানে। আবার পাপড়ি রহমানের ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’য় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী মানুষগুলোর জীবনের বেদনা ফুটে উঠেছে। উপন্যাসে কলকাতা অংশে আমরা পাই, অভিজিৎ সেনের ‘ঝড় ও নীলবিদ্যুৎ’ আলোচক অনুপম হাসান, বীরেন শাসমলের ‘জলকর’ আলোচক আবদুল আজিজ, সাদিক হোসেনের ‘মোন্দেলা’ আলোচক ইশরাত তানিয়া, অধীর বিশ্বাসের ‘লাস্টবয় অচ্ছুত বালকের ক্লাসরুম’ আলোচক তপন বাগচী, অসিত দাসের ‘পঞ্চানন কুশারীর কবিয়ালি’ আলোচক বাবলু জোয়ারদার, অভিষেক সরকারের ‘মূকনায়ক’ আলোচক মাজেদা মুজিব, সসীম কুমার বাড়ৈর ‘দেড়শো গজে জীবন’ আলোচক মুম রহমান এবং শুক্তি রায়ের ‘মায়াবিনী’ আলোচক শিবশঙ্কর পাল। অভিষেক সরকারের ‘মূকনায়ক’ উপন্যাসে একটা চমৎকার তথ্য উৎখনিত হয়, যার মাধ্যমে জানা যায়Ñ আজকের শূদ্ররা একসময় ছিল ক্ষত্রিয়, যারা ব্রাহ্মণদের রোষে পড়ে নিপতিত হয় ঘৃণার অনলে।

কলকাতার সাহিত্যিকদের আত্মজৈবনিক গ্রন্থের মধ্যে আলোচিত হয়েছে প্রিয়দর্শী চক্রবর্তীর ‘জীবনের সমুদ্র সফেন’ আলোচক ফরিদুর রহমান। গ্রন্থটিতে সলিল চৌধুরী, সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কথা এবং গণজাগরণে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা। মন খারাপ করা স্মৃতি নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বাঙালির গর্ব, কিংবদন্তি গণসংগীত শিল্পী, হবিগঞ্জের জালালী কইতরখ্যাত হেমাঙ্গ বিশ্বাস। যিনি দেশবিভাগের করুণ পরিণতিতে নিজের ভাষ্যে ‘ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কৈলকাত্তার উপর’। এ ছাড়া মননশীল সাহিত্যধারার আলোচনা যেমন এসেছে, তেমনি বাদ পড়েনি অনুবাদ সাহিত্যও।

লিটলম্যাগ আলোচনা অংশে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের ‘পর্ব’ সম্পাদক মজিদ মাহমুদ এবং আলোচক জয়গোপাল মন্ডল, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান সম্পাদিত ‘সপ্তক’ আলোচক বিদুষী ব্রহ্ম, সরোজ সাহার আলোচনায় সরোজ দেব সম্পাদিত ‘শব্দ’। কলকাতার লিটলম্যাগ ‘উৎসবিন্দু’ যার সম্পাদক গৌতম অধিকারী, আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের লেখক ও সমালোচক জয়দীপ দে। কলকাতার নীলাদ্রি শেখরের সম্পাদনায় কথাকৃতি ‘পঞ্চাশে তপনজ্যোতি’ আলোচনা করেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক এবং হাল আমলে ‘ঘোর’-এর ঘোর না কাটানো পরিচালক বীরেন মুখার্জী। তাপস রায় সম্পাদিত ‘সুইনহো স্ট্রিট’ আলোচনা করেছেন মনজু রহমান এবং সর্বশেষ আলোচনা গৌতম অধিকারীর ‘গল্পদেশ’, যা সাইফ বরকতুল্লাহর বিশ্লেষণে বহুবর্ণী জীবনের খন্ডচিত্র হিসেবে বর্ণালি টেনে গেছে।

পাঠ-আলোচনার এই ‘জলধি’ সংখ্যায় যার বই আলোচিত হলো তিনিই যদি আবার অন্য কারো বইয়ের আলোচক না হতেন, তবে বিষয়টি আরো নির্মোহ হয়ে উঠতে পারত। কিছু কিছু বানানের প্রমাদ চোখে লেগেছে। তবু সব ছাপিয়ে ‘জলধি’ পাঠ-পর্যালোচনা সংখ্যাটি সত্যিকার অর্থেই তার নামের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাপক বিস্তৃতি ও গভীরতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। তবে আমপাঠকের কথা বিবেচনায় রেখে এ ধরনের সংখ্যার মূল্য আর একটু হাতের নাগালে রাখতে পারলে সবার পিপাসা প্রশমনে সমর্থ হবে বলে অনুমান করা যায়। ‘জলধি’ যে মহৎ প্রয়াস নিয়ে তার সাহিত্যের ঊর্মিমালায় গর্জনশীল হয়ে উঠেছে, তা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধি অর্জন করুকÑ এই শুভকামনা নিরন্তর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close