তুষার প্রসূন

  ১৯ জুন, ২০২০

এক টাকার একটা নোট

অতীত বর্তমানের সাঁকো

দেশের প্রান্তিক মহকুমা সদরের ছোট্ট শহর। বড় একটি মহল্লা। দক্ষিণে উর্দুভাষী মানুষ, মুসলিম। পশ্চিমে বাংলাভাষী মানুষ, হিন্দু। পূর্বে মুসলিম কিন্তু বাংলাভাষী মানুষ। বৈচিত্র্যের ত্রিধারা। বাড়িগুলো জড়াজড়ি, পাশাপাশি। বিকালে শিশুরা উত্তরের লাগোয়া সড়ক পার হয়ে মুন্সেফ কোর্টের মাঠে খেলায় মেতে ওঠে। বড়রা যে যার কাজে চলে যায়। গোধূলির আধাবিষণœ রং এদের সবাইকে কুড়িয়ে যার যার বাড়িতে দিয়ে যায়। শহরের মধ্যে নিয়মের একটা চিহ্ন ভেসে ওঠে।...

রাজা সহিদুল আসলামের উপন্যাস ‘এক টাকার নোট’-এর শুরুটা এভাবেই। শুরুতেই বোঝা যায় উপন্যাসের ধরন। গল্পের মধ্যে অন্তর্নিহিত যে গল্প থাকে, সেখানে লেখক তুলে ধরেছেন আমাদের আবহমানকাল ধরে বয়ে চলা সহজ-সরল জীবনের গ্রাফিকস, যেখানে বর্তমানের সঙ্গে একটি পরম্পরা আঁকা আছে। পাঠকের ধ্যান সেই চিত্রকে আবিষ্কার করতে পারবে। গল্প বলতে বলতে কথাশিল্পী পাঠককে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রেম, জীবনাচরণ নিপুণ স্বরলিপিতে তুলে ধরেছেন।

এক টাকার নোটের মুখবন্ধে কথাশিল্পী সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ উপন্যাসটির চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন এভাবেÑ ‘আজাদ প্রমিলাকে বলে, দিদি বয়স বাড়লে কি দূরত্ব বাড়ে? অথবা গোরস্তান ও শ্মশান যখন একই ভূমিতে, পাশাপাশি, তখন কোন চিত্রকল্প ভেসে ওঠে পথিকের মনে? বলা যেতে পারে সেই একসময়ে; সমাজ সংসার নষ্ট-ভ্রষ্ট, খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়নি তখনও। শুভ নস্টালজিক সময়। মানবিক সম্পর্কের ধারণা নিয়ে মানুষ ভাব-ভালোবাসা, আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে আগলে রেখেছিল সমাজ-সংসার। সেসব দিনকাল ছিল আলোক সম্ভবা; ভাঙন এসে আঘাত হানেনি, ভেঙে পড়েনি সমাজ কাঠামো, জাত-পাত বিবাদ ও বিভেদ ঢেকে দেয়নি মানুষের মুখ, ছিঁড়ে যায়নি সম্পর্কের সুতো, কোথায় যেন মায়া বেঁচে ছিল।...’

আমরা যখন উপন্যাসের ভেতরে প্রবেশ করব দেখা যাবেÑ অতীতে আমাদের দেশে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের জীবনযাপন কত সহজ ছিল। মানুষের ভেতর ভেদাভেদহীন একটি শান্ত পরিবেশ বিরাজ করত। পুঁজিবাদের উত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ সামাজিক বিভিন্ন জটিলতা আমাদের কীভাবে সেই সাধারণ জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। শুধু শহুরে জীবন নয়, গ্রামীণ জীবনেও নেমে এসেছে বিভেদের অমানিশা। যে ধর্ম আমাদের মাঝে কোনো দিন বিভেদের দেয়াল টানেনি অথচ সেই ধর্ম নিয়ে আজ মানুষ শুরু করেছে রাজনীতি। ফলে উপন্যাসের আজাদ প্রমীলার ভালো লাগার সেই দিনগুলোর দিকে তাই পাঠকের ফিরে যেতে মন চাইবে।

গল্পের মধ্যে আজাদ প্রধান চরিত্র। সুমিত্রাকে ঘিরে আজাদের চরিত্র প্রবাহিত হয়েছে। লেখকের অসাধারণ বর্ণনায় উঠে এসেছে, সেসব চরিত্র। তিনি লিখেছেনÑ ‘সময় আর বয়স একই। পার্থক্য শুধু এইÑ বয়স হলে মানুষ চলে যায়, কিন্তু সময় থেকে যায়। বিভিন্ন বয়সে মানুষের মন ওঠানামা করে। আকাশের রঙের মতো। আজাদের মনটাও কি আকাশের রঙের মতো ক্ষণে ক্ষণে পালটাচ্ছে?

কখনো উদাস করা দুপুর। দূরে হয়তো ঘুঘু ডাকা গাছের ডালে অন্য পাখিদের বিশ্রাম। মানবশূন্য চরাচর, শুধু একা দাঁড়িয়ে। অতীতের সুখস্মৃতিও তখন পাশে এসে বসে না। খাঁ খাঁ করা বিষণœ প্রান্তর তার চোখে ভেসে ভেসে আসে। আর প্রবল বাতাস যেন সবকিছু ওলট-পালট করে তার দিকে ধেয়ে আসে। তাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এ রকম যখন হয়, নিজেকে রক্ষার জন্য টাঙ্গন নদীর কাছে চলে যায়। এর ওপর দিয়ে কলেজে গেছে। টাঙ্গন সেতুতে তার পায়ের ছোঁয়া লেগে আছে। সুমিত্রার পায়ের ছোঁয়া লেগে আছে। এ সময় টাঙ্গন তাকে শীতল পরশ দেয়। শরীর মন জুড়িয়ে আসে। আর টাঙ্গনের জলে স্মৃতিগুলো এসে কিলবিল করে। সে বড়শি ফেলে। একটা একটা করে স্মৃতি তুলে আনে। স্মৃতিগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার জলে ছেড়ে দেয়।...’

উপন্যাসের ভেতর আমরা যেটুকু ভ্রমণ করলাম, সেখানে এক টাকার নোটের সন্ধান আমরা এখনো পাইনি। তাহলে দেখা যাক ঔপন্যাসিক কীভাবে তার এই এক টাকার নোটের ব্যাখ্যা দিয়েছেনÑ ‘আজাদ কাকিকে নিয়ে (সুমিত্রার অসুস্থ মা) নিজের বাড়িতে চলে আসে। কাকিকে আজাদ তার নিজের বাড়িতে রাখার জন্য মা বাবাকে বলে। আজাদের বাবা-মা রাজি হয়।’

এরপরই প্রসঙ্গ আসে একটা এক টাকার নোটের। উপন্যাসটি শুরু করলে এই টাকার সন্ধান না করে পারা যাবে না। আর এই অনুসন্ধানী মন পাঠককে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ভ্রমণ করতে বাধ্য করবে। পাঠক তখনই আবিষ্কার করতে পারবে উপন্যাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা এক টাকার একটা নোটের প্রকৃত কাহিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close