ফকির ইলিয়াস

  ১৯ জুন, ২০২০

সংগ্রামে ভালোবাসায় বহমান যে কবি

আমার কৈশোরে পড়ার একটা বড় বিষয় ছিল কবিতা। ‘রাজনীতি’, ‘অর্থনীতি’, কার্ল মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিন কিংবা মাও, চেÑ পড়তে পড়তে যখন অন্যদিকে মন ফেরাতে চাইতাম, তখনই ডুবে থাকতাম কবিতায়। নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন আমার প্রিয় কবিদের অন্যতম। প্রিয় কেন হয়ে উঠেছিলেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো খুঁজি। উত্তর যে পাই না তা নয়। পাই। আর পেয়েই বুঝি, কেন তিনি এখনো আবর্তিত হন বারবার আমার মননে মনীষায়।

১৯৭০ সাল বাঙালির জীবনে একটি বাঁক পরিবর্তন শুরুর বছর। বাংলার জনপদ তখন উত্তপ্ত। আন্দোলন চলছে। ভোটের রাজনীতি আর দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশের দোলা তখন পদ্মা মেঘনা যমুনা সুরমার জলে। এই সময়েই প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’। বইটি বের হওয়ার পরই ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। কবি হিসেবে তিনি জানান দেনÑ ‘আমি আসছি!’

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতা আছে ‘হুলিয়া’। এই কবিতাটি চিত্রিত করেছে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ওই সময়ের সমাজ বাস্তবতাকে। হ্যাঁ, তখন হুলিয়া পিঠে নিয়ে দিগি¦দিক ছুটছে অগণিত তরুণ। আমি যতবারই ওই কবিতাটি পড়েছি, ততবারই ডুবে গিয়েছি সেই সময়ের আন্দোলনে, মিছিলে, রাজপথে, গ্রামে, সামাজিক চিত্রকল্পে।

একজন সমাজবিপ্লবী তার নিজের বাস্তুভিটেয় ফিরছেন! কবি লিখেনÑ ‘সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে/গ্রামে ফেরা, আমি কত দিন পর গ্রামে ফিরছি।’

কবির এই ফেরার সঙ্গে সঙ্গে যেন শহর থেকে গ্রামে গ্রামান্তরে ফিরে যায় হাজারো স্বাধীনতাকামী মুখ। যারা পরবর্তী সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যারা জানবাজি করে অস্ত্র হাতে হায়েনাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ‘যেন সবখানেই/সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি।’ এমনই তো ছিল ৭১ পূর্ববর্তী বাংলা। শোষণের দাবানল ক্রমশ জ্বালিয়েই যাচ্ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের পাঁজর। ‘হুলিয়া’ কবিতাটির মাধ্যমেই নির্মলেন্দু গুণ হয়ে উঠেছিলেন ১৯৭০-৭১ সালে হাজারো তরুণের কণ্ঠস্বর। দ্রোহ ও প্রেমের আখ্যানে এই কবিতাটি যে কতটা গভীরে পৌঁছতে পেরেছিল, তা এখনো আমরা অনুধাবন করতে পারি।

‘বহু দিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,/চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভেতরে সেই আমি/কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দি হয়ে গেলুম।’ কবি এই কবিতায় আমাদের উত্তপ্ত রাজনীতির মুখও চিত্রিত করেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। এই দৃশ্য আমরাও আজও দেখি স্বচ্ছ আয়নার মতো।

‘খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,/তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য।/রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস।/ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:/-আমাদের ভবিষ্যৎ কী?/-আইয়ুব খান এখন কোথায়?/-শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?’ সেই সময়ের গণ-আন্দোলনের কাব্যচিত্র এর চেয়ে বিশদ আর কী হতে পারে?

নির্মলেন্দু গুণ আপাদমস্তক রাজনীতির কবি। বাংলাদেশে ভূচিত্র ও গণমানসের চাওয়া-পাওয়ার যে ধারাবাহিকতা, এই কবি তা ধারণ করতে পেরেছেন অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে। গুণ যদি আরো কমই লিখতেন, তবু তাকে বাংলা কবিতা থেকে খারিজ করা যেত না। তার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা আছে, ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’। কবি এই কবিতাটি লিখেন ১৯৮০ সালে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর দেশে সামরিক শাসন চালু হয়। পাল্টে যেতে থাকে আমাদের মহান স্বাধীনতার ইতিহাস। এই প্রেক্ষাপটেই লিখিত কবিতাটি আমাদের জানিয়ে দেয়, স্বাধীনতা শব্দটি আমরা কীভাবে পেয়েছিলাম।

নির্মলেন্দু গুণ যেদিকে যানÑ সঙ্গে করে নিয়ে যান একখন্ড বাংলাদেশ। তার দেশপ্রেম আমাদের বিমোহিত করে। কবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ২৬ এপ্রিল ১৯৯১ সালে। ‘ডেলোয়্যার ভেলি বাংলাদেশ সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন বাংলাদেশের বিজয়ের ২০ বছর পালন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানেই প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। ওই সময়েই কবি নিউইয়র্কে খুঁজে পান ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’খ্যাত বিখ্যাত মার্কিনি কবি অ্যালেন গিনসবার্গকে। তার এ সফরের প্রায় নিত্যসঙ্গী ছিলেন দেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন। কবিকে আরো যারা ঘনিষ্ঠ সঙ্গ দিয়েছিলেন, তার মাঝে ছিলেন প্রাবন্ধিক আলম খোরশেদও। নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আমার আড্ডা দেওয়ার সুযোগ সেসময়েই ঘটে নিউ ইয়র্কে।

গুণ একাধারে কবি ও গদ্যকার। তার গদ্যের ভাষা খুবই ঝরঝরে। তিনি ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের অনেক দেশ। তার লেখা ভ্রমণ কাহিনিগুলোতেও এসেছে সেই সময়কালে ঘটে যাওয়া চলমান ঘটনা।

নির্মলেন্দু গুণের লেখা সাক্ষ্য দেয়, তিনি প্রধানত একজন সাম্যবাদী মানুষ। মানুষে মানুষে সংহতি, সহমর্মিতা, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এমনকি বাঙালি জাতিসত্তার পরিশুদ্ধ ইতিহাস নির্মাণেও তিনি থেকেছেন অবিচল ও সিদ্ধহস্ত।

সেসময়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন, সে সময়েই আমাদের একটি নিজস্ব পতাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। ১৯৬৭ সালে লেখা তার একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি আমরা পড়তে পারি। তিনি লিখেছিলেনÑ ‘শীতের রোগীর মতো জবুথবু নয়,/’গঞ্জের জনতার মতো নির্ভীক হতে হবে।/রক্তের রং দেখে ভয় নেই,/স্বাধীন দেশের মুক্তজনতা উল্লাস করো সবে। (সুবর্ণ গোলাপের জন্য)

তিনি এখনো বহমান আমাদের কবিতায়। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৭৫-এ জাতির পিতা হত্যাকান্ড, স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কবিতা আন্দোলন, ৯০-এর ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান, শহীদ জননীর গণ-আদালত, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা, গণজাগরণ মঞ্চ, সব অবিচার অনাচার, জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িকতা থেকে আজকের মহামারি করোনাকালেও কবিতায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন এই কবি।

নির্মলেন্দু গুণকে বলা যায় ‘হ্যাঁ প্রেমিক-হ্যাঁ বিপ্লবী’! কারণ তিনি দুটোতেই দেখিয়েছেন সমান দক্ষতা। প্রেম সম্পর্কে তার নিজের লেখা একটি সূত্র এখানে হাজির করতে চাই। তিনি লিখেছেনÑ ‘আমি যখন আমার জীবনের দিকে খুব গভীর দৃষ্টিতে তাকাইÑ কখনো কখনো একটি পূর্বনির্ধারিত জীবনের ছক আমার চোখে ভাসে। অন্য সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত জীবন-ছকের এ ধারণাটি হয়তো প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কিন্তু আমি নিজেকে পূর্বনির্ধারিত এক অসাধারণ জীবনের অধিকারী বলে ভাবি। তখনই আমার জীবনে ঘটে যাওয়া যাবতীয় রহস্যময় ঘটনার হিসাব মিলে যায়। আমার মনে হয়, ছোট কবিদের বড় কবি হওয়ার জন্য বড় ধরনের বিরহ দরকার পড়ে।’ (আমার কণ্ঠস্বর, পৃষ্ঠা ২০৮)

কবি নির্মলেন্দু গুণ, আজকের আরেক খ্যাতিমান গল্পকার পূরবী বসুর প্রেমে পড়েছিলেন। হয়তো তা ছিল একতরফা নিবেদনের ছায়া! পূরবীর সঙ্গে পরে আজকের আরেক কিংবদন্তি কথাশিল্পী ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বিয়ে হয়ে যায়। গুণ তার ‘আমার কণ্ঠস্বর’ আত্মগদ্য গ্রন্থে খুব প্রাঞ্জল ভাষায় সেসব কথাই আমাদের জানিয়েছেন, ২০৪ থেকে ২১০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত!

গুণ যা বিশ্বাস করেন, তা লিখেন। তিনি ‘কবিতাকুঞ্জ’ নির্মাণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অবারিত করে যেতে চাইছেন বিশ্বকবিতা পঠন-পাঠনের দরজা।

তিনি আমাদের সময়ের অত্যন্ত স্পষ্টবাদী কবি ও চিন্তক। তার দীর্ঘ জীবন সবারই কাম্য। ২১ জুন ১৯৪৫ সালে জন্ম নেওয়া এই কবি আমাদের যাপিত জীবন-সংগ্রামের ছায়া সংগ্রাহক। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close