কাজী লাবণ্য

  ০৫ জুন, ২০২০

বই আলোচনা

সত্যতার অব্যর্থ কাহন

কথাসাহিত্যিক রুখসানা কাজলের উপন্যাস ‘আলালদের আনন্দঘর’। বইটি হাতে নিয়ে মনে হলো, এটি কি বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখা হয়েছে? যদি তাই হয়, তাহলে তো খুবই আশার কথা। কেননা অনেক অভিভাবকই কিশোর-কিশোরীর পড়ার জন্য উপযুক্ত বই খুঁজে পান না। ফ্ল্যাপেও লেখা রয়েছে ‘কিশোর উপন্যাস’। এর চমৎকার রঙিন প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদের ছবি দেখেও মনে হয় এটি কেবল কিশোর-কিশোরী বা ছোটদের বই। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখি এটি আসলে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবাই পড়তে পারবে এমন একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস।

বইটির কেন্দ্র্রে রয়েছে আলাল নামের একটি সদ্য কিশোর। আলালকে কেন্দ্র করে এগোতে গিয়ে ‘আফসার’ নামের চরিত্রটিতে এসে বোঝা গেল, বইটিতে মূলত পুরুষদের পিতা বিশেষ করে সৎ পিতা বা বিপিতা হয়ে ওঠার চমৎকার একটি কাহিনি রয়েছে।

সাধারণত ঘর গেরস্থালি, সমতা সাম্যে সুযোগ পেলেই পুরুষের ওপর বেশ একহাত সমালোচনা করা হয়। সেক্ষেত্রে লেখক এখানে ‘আফসার’ নামক চরিত্রটিকে এক অদ্ভুত ভাঙাগড়ার মধ্যে নির্মাণ করেছেন। পুরুষ পিতা হতে চেয়ে গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করে না। কিন্তু আফসার একজন সৎ পিতা হতে গিয়ে যে মানসিক দ্বন্দ্বে জিতে পিতৃত্ব অর্জন করেছে, তা গর্ভযন্ত্রণার চাইতে কম কিছু নয়।

বলা যায়, লেখক এখানে আফসারের প্রতি সুবিচার করেছেন। কেন্দ্রে আলাল থাকলেও, আলালের সূত্র ধরে এসেছে ওর বন্ধু মাসুদ, হাফিজউল্লার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের বর্ণনা। এসেছে অমোঘ মৃত্যুর কথা। একটি ভেঙে পড়া পরিবার দেখাতে গিয়ে লেখক বেশকিছু মৃত্যু দেখিয়েছেন। মাসুদকে দেখিয়েছেন বাবা-মা হারানো দুঃখী এক কিশোর, যে মায়ের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে। মায়ের কবরের ওপর থেকে শুকনো পাতা সরিয়ে দেয়। ঘাস লাগিয়ে কবরটাকে সুন্দর করে তোলে। যেন মাকে যতœ করছে সন্তানের ভালোবাসা থেকে। পাঠকের মন ভরে ওঠে মমতায়। এমনটা আছে বলেই লেখার গতিময়তা মায়াবী হয়ে উঠেছে। এসেছে মৃত্যু নিয়ে অমোঘ সত্যতা। যে যায়, সে চিরদিনের জন্যই চলে যায়। দরদি শিক্ষক মাসুদের মাথায় হাত বুলিয়ে যে কথাগুলো বলেন, সেটাই নির্ধারিত নিয়তি। তিনি বলেন, ‘বাবা সকলেরা, এই যে তোমরা বেঁচে আছো এটা যেমন সত্য, তেমনি এক দিন আমরা মরে যাব, তাও ধ্রুব সত্য। এরমধ্যে ভূতপ্রেত জিনপরি বলে কিচ্ছু নাই।’

আলালের বাবার অকালমৃত্যু এবং ছোট ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে মধ্যবিত্ত ঘরের একজন স্বল্পশিক্ষিত মায়ের সংগ্রামের পাশে আফসারের চরিত্রটিকে নির্মাণ করে লেখক সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ এক দৃঢ় ব্যক্তিত্বকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তানদের স্নেহময় ‘বিপিতা’ বা সৎ পিতা হিসেবে পুরুষের অবস্থান। সমাজে সৎ মাতা আছে। গল্প উপন্যাস রূপকথাতেও সৎ মায়ের উপস্থিতি রয়েছে। সে যেভাবেই হোক। কিন্তু সৎ পিতাকে নিয়ে কি এভাবে কখনো লেখা হয়েছে?

যখন কিনা বর্তমান বাংলাদেশে ক্রিকেটের স্টাম্প ভাঙার মতো সংসারগুলো টপাটপ ভেঙে পড়ছে আর দিশাহীন হয়ে পড়ছে সে সংসারের সন্তানরা। সেক্ষেত্রে পুরুষ কী আসলেই এসব ভাঙনের শিকার শিশুদের পিতা হয়ে উঠতে পারেন! নাকি পারেন না! এ প্রশ্ন আমারও। অথচ একজন বিপতœীক পুরুষের ঘরে এসে একজন নারী স্বামী পুরুষটির আগের পক্ষের ছেলেমেয়েদের ‘মা’ হতে পারলে পুরুষ কেন স্ত্রীর আগের পক্ষের সন্তানদের ‘পিতা’ হতে পারেন না! (এখানে আমি বিমাতা শব্দটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছি)। এই বইয়ে খুকুর স্বামীর মৃত্যুর জন্য পরিবারটিতে ভাঙন আসে। অর্থাৎ বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেনি।

এখন নারীর নিজস্ব ভাবনা তৈরি হয়েছে। সমাজ, সংসার, অর্থবিত্ত, নিরাপত্তার বাইরে নারী এখন শারীরিক প্রয়োজনের বিষয়টাও ভাবতে শিখেছে। পুরুষ তার শরীরের ক্ষুধা তৃষ্ণা সেবাযতœ, চাহিদার কথা বলতে পারলে নারী কেন পারবে না? কেন নারীর জন্য তার পরিবার, সমাজ সংসার রাষ্ট্র নান্দীপাঠ করে না, নারীরও শরীর আছে। সে শরীরের ক্ষুধা তৃষ্ণা সেবাযতœ চাহিদাও রয়েছে। আলালচান্দার মা তাই সারা জীবন বালিশ কামড়ে থাকতে চাননি।

এক বসায় পড়ে ফেলার মতো রুখসানা কাজলের কৃশকায় উপন্যাস ‘আলালদের আনন্দঘর’। সময় উপযোগী একটি স্পর্শকাতর এবং জরুরি বিষয় নিয়ে লেখা উপন্যাসটির প্রতি লেখক সুবিচার করেননি। মনে হয়েছে তিনি খুব তাড়াহুড়ো করেছেন। আরেকটু ব্যাপ্তি থাকলে আরো ভালো হতো। বিশ্বাসই হতে চায় না, আলালের মমতাময়ী মা খুকু এতটা নির্মম হয় কী করে! লেখক সেটি দেখাতে পারতেন আরো কিছু ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে। কেন যেন মনে হয়েছে, দ্বিতীয় সংসারে এসে সন্তানদের প্রতি খুকুর এতটা উদাসীনতা বা কঠোরতা ঠিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যায় না। খুকুকে কেমন যেন স্বার্থপর বলে মনে হয়েছে। আরো কিছু ব্যাপার উল্লেখ করতেই হয়। ব্যাপক ড্রপ হয়েছে। কিছু কিছু শব্দ নাই হয়ে গেছে। এটা সম্পাদনার সময় দেখা দরকার ছিল। তাছাড়া একটি অধ্যায় শেষে আরেক অধ্যায়ে যাওয়াটা আরো সুচারুভাবে হওয়া দরকার ছিল। তবু সুখপাঠ্য। বিষয় নির্বাচনে আলাদা বলে হালকা পাতলা এ উপন্যাসটির ব্যাপক সাফল্য কামনা করছি।

উপন্যাসের শেষটা আনন্দময়। সমাপ্তিতে এই নতুন পিতা (এখানেও আমি বিপিতা শব্দটি এড়িয়ে গেলাম) ব্যাকুল হয়ে লাল্লা ও চান্দাকে আনার জন্য যখন ছুটে যাচ্ছে, তখন মধুমতির জলে বিকাল ধুয়ে সন্ধ্যা নামছে, দূরের মান্দার আর শিমুলগাছে নিঃশব্দে নেমে আসছে দিনচরা পাখিদের ঝাঁক।

এমন এক অলৌকিক সময়ে বাবা আফসার আনন্দিত ও দৃপ্ত কণ্ঠে বলছেন, ‘দুটোকে কষে বেঁধে রাখব এবার থেকে। কত বড় সাহস! বাবা-মাকে না বলে, নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে মামাবাড়িতে পালিয়ে আসা হয়েছে! নিজেরা না দেখলে ছেলেমেয়ে মানুষ করা কঠিন আজকাল।’ যেন ভূমিষ্ঠ সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে পিতৃত্ব অর্জনের আনন্দে পুরুষ জানাচ্ছে, আছি আমি। আমি আছি তোদের পাশে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close