আবদুল ওয়াদুদ দুলাল

  ০৫ জুন, ২০২০

স্মরণ : আশিক সালাম

আলোর সন্ধানে হাতছানি

শ্রম দেবো নিষ্ঠা দেবো নিবিড় নিশ্বাসে/স্বপ্ন ও প্রণয় দেবো গভীর বিশ্বাসে/খয়েরি পাতার ঠোঁটে ফোটাবো ফাগুন/হাপরের নিশ্বাসের গনগনে আঁচে/বানাবো কুঠার-হাতুড়ি-কোদাল-কাস্তে/জীবনে জীবন ঘষে জ্বালাবো আগুন। কবি আশিক সালাম সেই আগুন জ্বালিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু আলো দেওয়ার আগেই নিভে গেছে সেই জ্বলন্ত প্রদীপ। বলছিলাম নিভৃত পল্লীর সেই কবির কথা।

আশিক সালাম একজন কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহু প্রতিভার অধিকারী একটি বটবৃক্ষ রূপদর্শী কবি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তার কবিতায় রোমান্টিক আখ্যান, প্রেম অনুসূচক বাক্য বেশি পাওয়া যায়। যেমনÑ কী যে বোকা ছিলাম/প্রেম শিখি নাইÑ পত্র পাঠালাম/তুমি আজ অন্য ঘরে ভিন্ন পাত্রে অমৃত-অঞ্জলি/আমি মূঢ় কানামাছিÑ উ™£ান্ত ভ্রমর/ছুটে ফিরি ধু-ধু অনিশ্চিত ঠিকানায়।

অথবা ‘যেখানেই রাখি হাত স্পর্শমধু চাঁদের প্রপাত/ওষ্ঠ জানে চুম্বনের অমিয় প্রসাদ।’ অথবা ‘তুমি এত চুপ কেন? যেন/বাক্হীন স্ফুর্তিহীন অহল্যার মূর্তি!/সোমত্ত নদীর অন্তরঙ্গ ঢেউ কই?/বয়সের ঘড়িতে কি হিরেবর্ষপূর্তি!’

আধুনিক বাংলা কবিতার কাব্য ভুবনে তার ব্যতিক্রম অবস্থান লক্ষ করা যায়। কবিতার মনোজগতের ভেতর কবির নিজস্ব শব্দ চয়নে কারুকার্যময়তার কাব্যভাবের নতুন চিত্রকল্পের রূপ ফুটে ওঠে। কবির ভাষায়Ñ ‘এসো, কপট শুশ্রƒষা ভুলে/ধন্বন্তরি খুঁজে পেতে/চলো যাই তৃণমূলে/হাতিশুঁড়া গুল্মের শেকড়েÑ/নিপুণ সেলাই করি কালের অসুখ।’

তিনি বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় রত্মাকর জ্ঞানীর অধিকারী ছিলেন। কবির ব্যক্তিগত জীবন কেবল তার ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তির দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়। কবির জীবন ও শিল্পের গভীরে উপলব্ধি এবং তার বিবিধ ধ্যানধারণা তালাশ করে বলা যায়, কবির কল্পনা প্রতিভার সীমানা নির্ধারণ করা অসম্ভব। তিনি তার কবিতায় লিখেছেনÑ ‘সহসা সানাই বাজেÑবিষণœ সোরাই/পইপই খুঁজে ফিরি ‘তহুরা’-শরাব/‘যাও পাখি বলো তারে’Ñআকুতি ঝরাই/নদী ডাকি জল ডাকি করছি বিলাপ।’

কেউ যদি কবির নিজস্ব প্রতিভা অস্বীকার করে, তবে সেটা যথার্থ হবে না। যেমন তিনি বলেছেনÑ ‘লজ্জা কারে কয় তার জানা হলো না/নিজেই ছিল সে উলঙ্গ সুন্দর/ঈর্ষা কারে কয় তার জানা হলো না/নিজেই ছিল সহিংস পরম।’

তার কথার উদ্দেশ্য বোঝানোর মতো প্রকাশ ভঙ্গি ভাষা দেওয়া সম্ভব নয়। তার কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য সম্পর্কে একজন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ কেবল শিল্প-সৌন্দর্য ঘিরেই আবর্তিত হয় না। কাব্যের পরিম-লকে অধিকার করতে চায়। কবিতা নামক শিল্পটি সাহিত্যের অন্যতম শাখা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়; যা সংস্কৃতি সভ্যতার মননশীলতার আবেগ রহস্য রূপায়ণ। তার কবিতা পাঠকদের কাছে বৈচিত্র্যমুখী প্রাণবস্তু লাভ করে। দেশের প্রধান প্রধান কাগজগুলোর সাহিত্য পাতাকে আশ্রয় করে তার আত্মপ্রকাশে পাঠক বৃত্তের পরিধি ক্রমইে বিস্তৃতি লাভ করে চলছিল। তার কবিতায় মর্মার্থ খুঁজতে চাইলে মনের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে শব্দ, ছন্দের নিজস্ব স্বর-সুরে নিসৃত রসের অনুভূতি নিজস্ব শৈলী স্মৃতিচিত্র লোকজ উপাদান ও মানবসভ্যতার প্রকৃত শিকড়-ভূমি ও লোক সাহিত্য বা গ্রাম সাহিত্য অনেক উপাদানের ইশারা পাওয়া যায়। যেমন তিনি লিখেছেনÑ তোর নুন ভালো তোর রুটি ভালো/তোর সুড়সুড়ি খুনসুটি ভালো/তোর সুখজাগা বুকটান ভালো/তোর পেয়ালাতে সুখটান ভালো।’ ‘ওরে ভালো মায়ের ঝি/তোর ইতরামো তোরে মেখে দিছে কালো/পচে গেছে তোর সবটুকু শ্রী।’

কবি মানবজীবনে বিভিন্ন জাতি জনগোষ্ঠীর সভ্যতা, সংস্কৃতির সামাজিক আচরণের চমকপ্রদ সংজ্ঞা দিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি অন্ধকার অবস্থা থেকে বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের চর্চা দ্বারা আজকের সভ্য সমাজের রূপ ফুটে উঠেছে।

আশিক সালামের কবিতায় আলাদা একটা শৈলী লক্ষণীয়। রহস্যের প্রেমের পরশে দূরকে কাছে টানে। তার কবিতার গতি ও গন্ত্যব্যের অনুধাবন একটু ভেতরে। তার নিজস্ব শক্তিতে শব্দ ভা-ার ও লেখনীতে বাক্য নির্মাণের এক অভিনব কৌশলের ধারণা সুস্পষ্ট। কবি আশিক সালাম দৈনন্দিন দাম্পত্য-জীবনে সংসার ত্যাগী জীবনযাপন করেছেন। তার কবিতায় পারিবারিক অভিজ্ঞতার রূপ ফুটে ওঠে। এক ভাই বোনের নিবিড়তার সম্পর্ক তার গদ্য ও কবিতার ভেতরে রূপকল্প সঞ্চার করে। কবি আশিক সালাম সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধেŸ ছিলেন। তিনি নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে সত্যিকার মানবতার পরিচয় লাভ করেছিলেন। কবি লেখেনÑ ‘ভাঙতে পারি, ভাঙবো এবার/জগদ্দলের কঠিন শিলা/কুলুপআঁটা দরজা ভেঙে/এবার ছোঁবো আকাশ-নীলা।’

তার জীবনে সাহিত্যের পরিমাপ বিবেচনা করলে কাব্যগন্থের তালিকা বেশি নয়। লিখেছেন প্রচুর প্রকাশের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতার পরিচয় দিয়েছেন। এই সাহিত্য সমাজে তার কাছ থেকে তৃষ্ণা মিটানোর অনেক কিছু ছিল। ধ্রুব সত্য হলো, অকালে গোলাপ ঝরে গেল।

তিনি ছাত্রজীবনে মাসিক ‘হেমলক’ ও পরবর্তীতে শিল্প সাহিত্যবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘উচ্চারণ’-এর সম্পাদনা করেন। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘পূর্বরাগ পূর্বস্বর’ তার অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঈশপের গল্প’, ‘নদী ডাকি জল ডাকি’ ও ‘তৃষ্ণার্ত জিরাফ’। তার অপ্রকাশিত ছড়াগ্রন্থ ‘সাতটি রংয়ের সাঁকো’, ‘দেশের ছড়া ভাষার ছড়া’, ‘কাকের বাসায় কোকিল ছানা’। তার অপ্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ ‘দরোজায় করাঘাত’। পেশাগত জীবনে আশিক সালাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান শিক্ষক ছিলেন। শিল্প সাহিত্য ও ব্যাকরণেও ঈর্ষণীয় প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার অসময়ে চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল বাংলা কাব্যভুবনে। তবু কবির চলে যাওয়া মানে চিরতরে যাওয়া নয়। আশিক সালাম বারবার ফিরে আসবেন কবিতার কাছে, আমাদের কাছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close